আগাম ডলারের দাম বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংক

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


আগাম বা ফরোয়ার্ড ডলার ক্রয়ের ক্ষেত্রে দামের সর্বোচ্চসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে এক বছরের মধ্যে আগাম ডলার ক্রয়ের জন্য বর্তমান মূল্য বিবেচনায় বাড়তি গুনতে হবে প্রায় ১৪ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডলারের দাম বেড়ে হবে ১২৩ টাকা ৯১ পয়সা বা প্রায় ১২৪ টাকা। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, এমনিতেই দফায় দফায় ডলারের দাম বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। ঘোষণা দিয়ে ব্যাংকগুলো গত এক মাসে দুই দফায় প্রতি ডলারে এক টাকা বাড়িয়েছে। এখন আগাম ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আরো বাড়তি দামে ডলার কিনতে হবে। পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আগাম ডলার কেনাবেচায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া স্মার্ট হারের সাথে বাড়তি গুনতে হবে পাঁচ টাকা। বর্তমান স্মার্ট হার রয়েছে শতকরা সাত টাকা ১৪ পয়সা। এর সাথে পাঁচ টাকা যুক্ত করলে হবে ১২ টাকা ১৪ পয়সা। অর্থাৎ ১১০ টাকা ৫০ পয়সার সাথে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ যুক্ত করলে হবে ১২৩ টাকা ৯১ পয়সা। শুধু তা-ই নয়, আন্তঃব্যাংেকে ডলারের দাম বাড়লে কার্যকর আগাম ডলারের দামও বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, নতুন নিয়মে এক বছরের জন্য ডলার বুকিং দিয়ে রাখতে হলে গ্রাহককে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। এটা নির্ধারণ হবে এখন যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়, তার মাধ্যমে। যেটা স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত, সংক্ষেপে যার নাম ‘এসএমএআরটি’। প্রতি মাসের শুরুতে ‘স্মার্ট’ রেট জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর বেঁধে দেয়া দরে এখন আর ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ব্যাংকেই এলসি খুলতে গেলে দায় পরিশোধের জন্য আগাম ডলার বুকিং দিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক দরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দাখিল করছে। কিন্তু আড়ালে আগাম বুকিংয়ের নামে বাড়তি দাম নিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করার কিছুই নেই। কারণ এটা একটি আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস। অর্থাৎ কোনো গ্রাহক তার ভবিষ্যৎ বৈদেশিক মুদ্রায় দায় মেটানোর জন্য আগাম ডলার বুকিং দিয়ে রাখতে পারে। এ জন্য বাড়তি প্রিমিয়াম দিতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বাড়তি প্রিমিয়ামকে স্মার্ট রেট হিসেবে বিবেচনা করত। এ রেট এতদিন ৭ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল। গত আগস্ট থেকে এ রেট ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ রেটও অনেক ব্যাংক মানছে না। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্মার্ট রেটের সাথে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা নেয়ার অনুমোদন দেয় ব্যাংকগুলোকে। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, স্মার্ট রেট কার্যকর হওয়ায় ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে।

এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বৈঠকের মাধ্যমে প্রতি মাসেই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। চলতি মাসে দুই দফা ডলারের দাম বাড়িয়েছে। প্রথমে ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১০ টাকা করা হয়, যা কার্যকর হয় ৩ সেপ্টেম্বর থেকে। গতকাল আরেক দফায় প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতি মাসে রফতানি আয় হচ্ছে গড়ে ৪৭০ থেকে ৪৮০ কোটি ডলার। এগুলোর প্রায় পুরোটাই লেগে যাচ্ছে রফতানিকারকদের। রফতানির বিপরীতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় মেটাতে। বাকি যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ থাকছে সেগুলো তারা গ্রুপের অন্য কোম্পানির আমদানিতে ব্যবহার করত। এখন একই ব্যাংকে হলে ব্যবহার করতে পারছে। কিন্তু অন্য ব্যাংকে হলে পারছে না। কারণ অন্য ব্যাংকে ডলার স্থানান্তর নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রফতানির ডলার এখন বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা পাচ্ছে না। রেমিট্যান্স বাবদ প্রতি মাসে গড়ে ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি ডলার আসছে। এর বেশির ভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারি খাতের জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে। ফলে বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছেন না। তাদের যদি জরুরি কোনো পণ্য আমদানি করতে হয় তাহলে আগে ডলার বুকিং দিতে হয়। সেগুলো এক থেকে ছয় মাস মেয়াদি বা এক বছর মেয়াদিও হতে পারে। আগাম ডলার বুকিং দিয়ে সেই মেয়াদে এলসি খুলতে হবে। ফলে এখন আগাম ডলারের বাজার বেশ জমজমাট। মেয়াদ অনুযায়ী ডলারের দামও বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু টাকা দিতে হয় নগদ। অর্থাৎ এক মাস মেয়াদি আগাম কিনলে এখন টাকা দিয়ে এক মাস পর ডলার পাওয়া যাবে। এতে অনেক ব্যাংক শর্ত দিচ্ছে, যদি ডলার সরবরাহ করার সময় আগাম রেটের চেয়ে বেশি হয় তখন বাড়তি দামও দিতে হবে। আগাম ডলারও আছে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকের কাছে।

এ দিকে বাফেদা ও এবিবির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও আগাম ডলারের বাজার ও নগদ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে না। ব্যাংকগুলোই চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর বাজারদরের চেয়ে আগাম বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে।

ব্যাংকগুলো সাধারণত নির্ধারিত মেয়াদের ভিত্তিতে এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য আগাম ডলার কিনে থাকে। কারণ এখন ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ কারণে আগাম ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে দামও বেশি। তারপর চাহিদার কমতি নেই। চড়া দামে ডলার কিনে ব্যয় মেটাতে হচ্ছে বলে আমদানির খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাজারে বাড়ছে আমদানি পণ্যের দাম। এর প্রভাবে অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেড়েই যাচ্ছে। গত আগস্টেও এ হার বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। এটা সর্বশেষ কোন অবস্থায় গিয়ে ঠেকে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *