গাজীপুর: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়তনের মহানগর গাজীপুর মহানগর। গাজীপুর মহানগর ও জেলা মিলিয়ে গাজীপুর বিএনপির অবস্থান। এই জেলায় রয়েছে ৫টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা ও গাজীপুর মহানগরে ৮টি সাংগঠনিক থানা। সব মিলিয়ে গাজীপুর কেন্দ্রিয় রাজনীতিতে রাজধানী ঢাকাকে প্রভাবিত করে। গাজীপুর জেলা বিএনপিতে আভ্যন্তরীন কোন্দল থাকলেও চাপা পড়ে আছে। তবে গাজীপুর মহানগর বিএনপিতে আভ্যন্তরীন কোন্দল অনেকটাই স্পষ্ট। পদের জন্য মরিয়া কিছু বিএনপি নেতার ইন্দনে কেন্দ্র ঘোষিত গাজীপুর মহানগর বিএনপির দুটি মাত্র পদের দুই নেতা অনেকটা বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমের একাধিক সংবাদ দুই জনের বিভক্তিকে অনেকটাই স্পষ্ট করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ৯জুলাই গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে দুই জনকে মনোনীত করে কেন্দ্র কমিটি। সভাপতি পদে সাবেক কাশিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন সরকার ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রয়াত মেয়র ও প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক এম এ মান্নানের ছেলে মঞ্জুরুল করিম রনিকে মনোনীত করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি। কথা ছিল ১৫দিনের মধ্যে তারা পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস হয়ে গেলেও পূর্নাঙ্গ কমিটি হচ্ছে না। গোপন সূত্র বলছে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতের অমিল হওয়ায় পূর্নাঙ্গ কমিটি করা যাচ্ছে না। তাই গাজীপুর মহানগর বিএনপিতে পদে থাকার জন্য একাধিক নেতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আনুকূল্য অর্জনে মরিয়া হয়ে গেছেন। গাজীপুর মহানগর বিএনপির অন্যান্য পদে প্রার্থীর সংখ্যা অনেক। বিশেষ করে বড় পদগুলোতে প্রার্থী বেশী। সভাপতি না সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপে থাকলে পদ নিশ্চিত হবে সেটার জন্য দুই নেতার চারপাশে অসংখ্য পদপ্রত্যাশী নেতা রয়েছেন। এই সুযোগে একটি চক্র নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে দুই নেতার মধ্যে পরস্পর বিরোধী অবস্থান তৈরী করেছেন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকারের বক্তব্য দুই নেতার বিভক্তির ইঙ্গিত বহন করেছে। তার মধ্যেই ৯সেপ্টেম্বর গাজীপুরে একটি রেষ্টুরেন্টে মতবিনিময় সভা আহবান করেন সভাপতি শওকত হোসেন সরকার। সরকার বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়ে করা এই মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সভাপতি শওকত হোসেন সরকার বলে উঠেন, তিনি কালিয়াকৈর তথা গাজীপুর-১ আসনে বিএনপির সবচেয়ে বড় নেতা। তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন আর দল দিলে তিনি নির্বাচন করবেন। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়।
নিজের বক্তব্য প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার বলেন, আমি কথাগুলো এই ভাবে বলিনি। আমার বক্তব্য খন্ডিত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি বিএনপির গাজীপুর মহানগরের সভাপতি। আমি গাজীপুর সিটিকরপোরেশন বা গাজীপুর-১ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারি। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব। আমি বড় নেতা নই। আমি একজন জিয়ার সৈনিক মাত্র। তিনি তার অনিচ্ছাকৃত কোন বক্তব্য ও বিকৃত বক্তব্যে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন সেজন্য দু:খ প্রকাশ করেন।
এই বিষয়ে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিম রনি বলেন, উনি কি বলেছেন জানিনা। তিনি গাজীপুর মহানগর বিএনপি ঐক্যবদ্ধাভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করছে দাবী করে বলেন, বিএনপি বড় দল। এখানে টুকটাক মনোমালিন্য থাকতেই পারে। এটা কোন বিষয় নয়। খুব দ্রুত গাজীপুর মহানগর বিএনপির পূর্নাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রের নির্দেশে ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান। একই সাথে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সৈনিক হয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমান সহ সকল বিরোধী নেতা-কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করার আন্দোলনে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান মঞ্জুরুল করিম রনি। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দল ও ভোটাররা চাইলে তিনি গাজীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। তার বিশ^াস তার বাবা গাজীপুরের মাটি ও মানুষের নেতা অধ্যাপক এম এ মান্নানের মতাদর্শে বিশ^াসী বিএনপি সহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ দল মত নির্বিশেষে ধানের শীষকে বিজয়ী করবেন। ১৯৯১ সনে তার বাবা অধ্যাপক এম এ মান্নান বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী ভোটে এমপি ও ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রথম মেয়র হওয়ার কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে রনি বলেন, গাজীপুর বিএনপির ঘাঁটি। এটা প্রমানিত। আমরা আবারো তা প্রমান করব।
এ বিষয়ে গাজীপুর-১ আসনের অধীন কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, এখন আন্দোলনের সময়। কে বড় নেতা, কে ছোট নেতা, তা বলবে দল। আমাদের প্রতিপক্ষ আওয়ামীলীগ, বিএনপি না। তাই অতিরঞ্জিত কথা না বলাই ভালো। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে শরীক হওয়ার আহবান জানান। হেলাল উদ্দিনের সমর্থকেরা বলছেন, গাজীপুর-১ আসন থেকে হেলাল উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। দল মনোনয়ন দিলে তিনি ধানের শীষকে বিজয়ী করতে সক্ষম।
গাজীপুর-১ আসনের বাসিন্দা, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদস্য সচিব, বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল বলেন, উনি এই কথাটা কি ভাবে বলেছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি না। তবে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। বিএনপির কালিয়াকৈর এলাকার একাধিক নেতা বলছেন, গাজীপুর-১ আসনে জননেতা কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল ধানের শীষ চাইবেন। দল মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচন করবেন।
গাজীপুর-১ আসনের কালিয়াকৈরের শ্রমিক নেতা ও বিএনপির কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ূন কবির খান বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তবে অযোগ্য লোক পদ পেলে এমনি করে। আমি বিএনপির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আছি। বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদকের পাশাপাশি শ্রমিক দলেরও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি বা আমরা এ ধরণের কথা বলতে পারি না। কালিয়াকৈরের একাধিক নেতারা বলছেন, গাজীপুর-১ আসনে হুমায়ূন কবির খান বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন। তারা আশা করেন, দল তাকে মনোনয়ন দিবে।
গাজীপুর-১ আসনের কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো: মুজিবুর রহমান বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। তবে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে দায়িত্বশীল কথা বলা উচিত। আমি আশা করি গাজীপুর মহানগর বিএনপি এক ও ঐক্যবদ্ধ। দল যাকে মনোনয়ন দিবে আমরা তার হয়েই কাজ করব।
বিএনপির সাধারণ কর্মীরা বলছেন, এই মুহুর্তে ঝগড়া বিবাদ নয়। নিজেদের মুখ নিয়ন্ত্রন করে দল ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করাই মূল লক্ষ্য। দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রেখে আন্দোলন করে একটি সুষ্ঠু ভোট আদায় এখন মূল দাবী। তারা সকল বিএনপি নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।