প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ করে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অবসরে যাচ্ছেন। আগামীকাল রবিবার থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টে অবকাশকালীন ছুটি থাকবে বলে তার শেষ বিচারিক কার্যদিবস ছিল গত বৃহস্পতিবার। এদিন আপিল বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছেন দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ এ পদ শূন্য হচ্ছে। ওই দিনই দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতির শপথ নেওয়ার কথা। কিন্তু কে হচ্ছেন ২৪তম প্রধান বিচারপতি তা নিয়ে এরই মধ্যে আইন অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। আর এই আলোচনায় দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
একাধিক সূত্র বলেছে, দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে ওবায়দুল হাসানকে নিয়োগের বিষয়ে এরই মধ্যে সরকারের শীর্ষপর্যায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত তার নিয়োগের বিষয়টি কোনো সূত্র নিশ্চিত করছে না। সূত্রগুলো বলছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপনটি আগামী ৪ সেপ্টেম্বরের আগে অথবা ১৬ সেপ্টেম্বরের পরে হতে পারে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর পর আপিল বিভাগে আরও যে ছয়জন বিচারপতি রয়েছেন তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হলেন ওবায়দুল হাসান। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন।
সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’
তবে এ বিষয়ে সংবিধানে বিস্তারিত আর কিছু উল্লেখ না থাকায় দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের থেকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করে থাকেন।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীসহ বিচার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে অতীতে একাধিকবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হলেও এবার তা করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও বর্তমান সরকারের নীতির (মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী) সঙ্গে মিলে যাওয়ায় এবার প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নিয়োগ অনেকটাই নিশ্চিত।
বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চের মধ্যে একটিতে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী নেতৃত্ব দেন। অপর বেঞ্চের নেতৃত্বে রয়েছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এদিকে বর্তমান প্রধান বিচারপতি আগামী ১১ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর দেশের বাইরে থাকবেন, এ সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
যিনি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হবেন রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়ে তার বিষয়টি প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ওই বিচারপতির ব্যাপারে ফাইল প্রস্তুত করে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ আকারে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর ফাইলটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করবে আইন মন্ত্রণালয়।
এদিকে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন আগামী ৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকবেন বলে জানা গেছে। এ সময়ের আগে বা পরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ছাড়া আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির মধ্যে ওবায়দুল হাসানের পর জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসারে রয়েছেন- বিচারপতি বোরহানউদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী এবং বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।
দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন- এই প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘চিফ জাস্টিস তো হবেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান; যেহেতু উনি সিনিয়র, উনি হচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন, তবে যিনি সিনিয়র তাকেই যে দিতে হবে তা কিন্তু নয়, এর আগেও অনেকবার এই সরকারের আমলে সিনিয়র বাদ দিয়ে অন্যজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ পর্যায়ে তা হচ্ছে না।’ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হবেন, এমন নিশ্চয়তার বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সরকারের পলিসি আমরা বুঝতে পারি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ একটি সিস্টেমের মধ্যে করে থাকে। আপিল বিভাগে যখন বিচারপতি নেওয়া হয় তখন থেকেই হিসাবনিকাশ করেই নেওয়া হয়। এসব বিবেচনায় বলা যায় তিনিই নিয়োগ পাচ্ছেন।’
সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী মো. মজিবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসেবে আইনজীবী সমাজ ওবায়দুল হাসান স্যারকেই যোগ্য মনে করেন। মেধা, সততা ও যোগ্যতার নিরিখে তিনি একজন পরীক্ষিত বিচারক। সুতরাং প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনিই অভিষিক্ত হবেন বলে আমরা মনে করি।’
বার কাউন্সিলের কমপ্লেইন অ্যান্ড ভিজিলেন্স কমিটির চেয়ারম্যান ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে সরকারের সন্তুষ্টির ওপর। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি নিয়োগে দেবেন। তবে আমরা সবসময় দেখে আসছি যে, এই সরকার সবসময় সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকেই এই পদে নিয়োগ দিয়ে আসছেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। যিনি এবার নিয়োগ হবেন তিনি তার আগের প্রধান বিচারপতির মতো বিচার বিভাগকে শৃঙ্খলার মধ্যে চালাবেন বলে আমি বিশ^াস করি।’
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস, এমএসএস ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের মধ্যে ১৯৮৬ সালে তিনি জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ১৯৮৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান; এর দুই বছর পর ২০১১ সালে একই পদে স্থায়ী হন। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ২০১২ সালের ২৩ মার্চ তিনি সদস্য হিসেবে যোগ দেন। একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তিনি এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়ে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।