স্কোপোলামিন। এক ভয়ঙ্কর মাদকের নাম। অপরাধ জগতে এটি ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস নামে পরিচিত। এই মাদক প্রয়োগে ১৫ মিনিটের জন্য ভুক্তভোগীকে বশীকরণ করা সম্ভব। কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলিসহ বিভিন্ন দেশের অপরাধীরা যৌন মিলনে বাধ্য করতে এই মাদক ব্যবহার করে। পর্নোগ্রাফি তৈরি করতে বা নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়। মাদকাসক্তরা এ ভয়ঙ্কর মাদক ব্যবহার করলেও সত্য উদঘাটনে বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও ক্ষেত্রবিশেষে এটি ব্যবহার করে। আশঙ্কার কথা হলো, সম্মোহন করার বিশেষ ক্ষমতার এই ড্রাগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের হাতে। কয়েকটি চক্রে বিভক্ত হয়ে দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর এই মাদকের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু ইরানি নাগরিক।
স্কোপোলামিনের প্রভাবে কয়েক মিনিটেই স্বেচ্ছায় নিজেদের মূল্যবান মালামালসহ টাকা-স্বর্ণালঙ্কার হারাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চলতি বাস-ট্রেন ছাড়াও বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়ছে চক্রের সদস্যরা। এই মাদক ছড়িয়ে প্রতারণার অভিযোগে গত আট মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৬ ইরানি নাগরিকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তারদের বর্ণনায় উঠে এসেছে এই চক্রের ভয়াবহ তথ্য।
সূত্র জানায়, স্কোপোলামিন কোনোভাবে নাকে শোঁকানো গেলেই ভিকটিম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এরপর ১৫ মিনিট পর্যন্ত ভিকটিম দুর্বৃত্তদের নির্দেশ মতো কাজ করবে। এমনকি ড্রাগ আসক্তদের দিয়ে জঘন্য অপরাধও ঘটানো হচ্ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু না নেওয়া; অপরিচিতকে গা ঘেঁষতে না দেওয়া এবং অপরিচিত কেউ কিছু পড়তে দিলে তা না পড়ার পরামর্শ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।
রাজধানীর পল্লবীতে ট্রাভেল এজেন্সির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন মো. জিসান। গত ২১ জানুয়ারি ইরানের পার্ভিজ মোহাম্মদ ও মেয়সাম ঘরবানি বিমানের টিকিট কিনতে আসেন। তাদের একজন হঠাৎ জিসানের নাকের সামনে দিয়ে ডান হাত ঘুরিয়ে নিয়ে যান। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য আর কিছু মনে নেই তার। পরে প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েÑ ওই দুই বিদেশির একজন জিসানের সামনে থাকা ক্যাশবক্স থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যাগে ভরে নিয়েছেন। তখনো তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছিলেন জিসান। ৫ মিনিট পর জিসান বিষয়টি বুঝতে পারেন। এই ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. রকিব মিয়া। কিন্তু ৬ মাসেও ফেরত পাননি চুরিকৃত টাকা।
এই ঘটনার ছয়দিন পর একই কৌশলে প্রতারণার শিকার হন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মাহবুবা আক্তার। গত ২৭ জানুয়ারি তার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন সেলিম আহমেদ নামে একজন। ফ্ল্যাট দেখে পছন্দ হলে পরদিন স্ত্রী ও মা পরিচয়ে দুই মহিলাকে নিয়ে ফের ওই বাড়িতে আসেন তিনি। একসময় মাহবুবা দুই নারীকে নিয়ে তার শোবার ঘরে যান। এরপর আগন্তুক বৃদ্ধা নারীর হাতে স্বেচ্ছায় তুলে দেন হাতের চুড়ি, কানের দুলসহ প্রায় ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়েও দেন তিনি। ট্রাভেল এজেন্সির করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই চিন্ময় সরকার আমাদের সময়কে
বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত ঘরবানিকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূলহোতা পার্ভিজ ঘটনার রাতেই দেশ ছাড়েন। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রেপ্তার যুবক সংঘবদ্ধ ডেভিল ব্রেথ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই চক্রে জড়িতদের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হবে।
গত ৪ আগস্ট ইরানি নাগরিক আজাদ নুবাহার ও আরশাদ আমনসহ ৪-৫ জন বগুড়ার শিবগঞ্জ সদরে হৃদয় টেলিকমে ঢুকে অডিট করবেন বলে জানান। একপর্যায়ে ইরানি তরুণরা নেশাদ্রব্য দুলাল মিয়া এবং তার ভাগ্নের চোখ ও মাথায় লাগিয়ে দেন। পরে প্রতারকদের কথামতো ক্যাশবক্স থেকে প্রায় এক লাখ টাকা বের করে দেন তারা। প্রায় এক ঘণ্টা পর সম্বিৎ ফিরলে বুঝতে পারেন প্রতারণার বিষয়টি। এ ঘটনায় গত ৯ আগস্ট নওগাঁ সদর থেকে আজাদ ও আরশাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিবগঞ্জ থানার ওসি আবদুর রউফ জানান, মাদকদ্রব্যের মাধ্যমে ভিকটিমদের সম্মোহিত করে তারা টাকাগুলো হাতিয়ে নেয়। চক্রের অন্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত ১৮ জুন রাজধানীর বাংলামোটর থেকে ৭৫ হাজার টাকার স্যানেটারি ফিটিংসসামগ্রী নিয়ে বাসাবোর নন্দিপাড়ায় যাচ্ছিলেন ভ্যানচালক হুকুম আলী। বাসাবো ওয়াসা রোডের ফুটপাতের একটি চায়ের দোকানে চা পান করতে বসেন। তার পাশেই বসা ছিলেন অপরিজিত দুজন। তিনি চা খেয়ে কিছুদূর যেতেই মোটরসাইকেলে এক ব্যক্তি এসে বলেন, এই মাল এখানে নামবে। তার কথামতো তিনি মালামালগুলো নামিয়ে দেন এবং দুর্বৃত্তদের গাড়িতেও তুলে দেন।
গত ৮ এপ্রিল যশোরের অভয়নগর উপজেলার বর্ণী হরিশপুর বাজারের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকান মরিয়ম স্টোরে প্রবেশ করেন দুজন ক্রেতা। এরপর মালিক শরিফুল ইসলামকে নেশাদ্রব্য শুঁকিয়ে তাকে স্মৃতিভ্রম করেন। একপর্যায়ে তাদের কথামতো শরিফুল তাদের হাতে তুলে দেন ৬ লাখ টাকা। এ ঘটনায় পুলিশ ইরানি নাগরিক খালেদ মহিবুবী, সালার মাহবুবী ও ফারিবোরয মাসুফি এবং বাংলাদেশি খোরশেদ আলম ও সাইদুল ইসলাম বাবুকে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকা ও যশোর শহরের হোটেল সিটি প্লাজা থেকে গ্রেপ্তার করে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন জানান, স্কোপোলামিন একটি ভয়াবহ মাদক। অপরাধ জগতে এর নাম শয়তানের নিঃশ্বাস। এ মাদক পথচারীদের নিঃশ্বাসে প্রয়োগের মাধ্যমে মাইন্ড কন্ট্রোল করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে চক্রটি। স্বেচ্ছায় নিজের মূল্যবান জিনিসপত্র তুলে দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। চক্রটি যশোরসহ ৩২ জেলাতে সক্রিয় রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার ৫ জন সংঘবদ্ধ ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ প্রতারক চক্রের সদস্য। চক্রের তিন ইরানি নাগরিক প্রথমে ফেসবুকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এর পর তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে এসে কয়েকজনের সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন জেলায় প্রতারণামূলক কাজ করে। এসব ইরানি নাগরিক বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এলেও সম্প্রতি তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশিদের সহায়তায় তারা লুকিয়ে এতদিন এসব প্রতারণা করছিলেন। চক্রটি শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশেও প্রতারণা করে এসেছে। ২০১২ সাল থেকে চক্রগুলো এসব করে এলেও সম্প্রতি স্কোপোলামিন প্রতারণা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জানা গেছে, স্কোপোলামিনের উৎপত্তি কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়।