যৌন হয়রানির অভিযোগ কেন ‘ধামাচাপা’ দিতে চায় বাসদ

Slider বাংলার মুখোমুখি


বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ-সহ দলটির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও অভিযোগ আমলে নেননি দলটির নীতিনির্ধারকরা। বরং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এ ঘটনাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘টাচ বিষয়ে বুঝতে না পেরে ভুল বুঝাবুঝির’ মতো শব্দগুলো ব্যবহার করে অভিযোগ ‘ধামাচাপা’ দিতে ব্যস্ত। এমনকি দলের কিছু নারীনেত্রীকে দিয়ে অভিযুক্তদের অবস্থানের পক্ষে ফেসবুকে নানা ধরনের পোস্ট লিখিয়ে নেওয়ার বিষয়ও দেখা যাচ্ছে। এদিকে বিভিন্ন বাম সংগঠন এরইমধ্যে এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত চেয়ে ও বাসদের তদন্তবিমুখ অবস্থানের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো অন্যতম প্রধান প্রশ্নটি হলো— যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে না নিয়ে কেন ‘ধামাচাপা’ দিতে চায় বাসদ?

দলটির ছাত্র সংগঠনের (সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট) সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমান গত ৭ জুন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো, যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো দলীয়ভাবে ধামাচাপা দেওয়া ও ভিকটিম (যৌন হয়রানির শিকার) ব্লেমিংসহ বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ করেন। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবি জানান অন্যান্য ছাত্র নেতারা। শোভন রহমানের ফেসবুক পোস্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ ফেসবুকে প্রকাশিত হতে থাকে। যদিও অভিযোগের আঙ্গুল যাদের দিকে— সেই বজলুর রশিদ ফিরোজ ও ইমরান হাবিব রুমন বিভিন্ন মাধ্যমে অভিযোগগুলোকে ‘মিথ্যা’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘বানোয়াট’ বলে অভিহিত করেন।

বাসদ কি যৌন নিপীড়নের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ মানে?

২০০৮ সালে কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করা হয়। শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে রায় দেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই রায়ে হাইকোর্ট দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ গ্রহণের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’সহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেন আদালত।

রাজনৈতিক দলের ভেতরে যদি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে ‘সেল গঠন’ করে তদন্ত ও বিচার সম্ভব কিনা এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বাসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিখিল দাস ফেসবুকে এর উত্তর দেন। তিনি মনে করেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, করপোরেট অফিস, এনজিও, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে তখনই, যখন বামপন্থী দলগুলোতে এটি কার্যকর করার দাবি উঠেছে, আবার খোদ বামপন্থিরাই এই দাবি তুলেছেন। এ বিষয়ে আমার কথা হলো, একটি মার্কসবাদী পার্টি ও বুর্জোয়া ব্যবস্থার কোনও প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া এক হতে পারে না।’

ঢাল হচ্ছেন নারীকর্মীরা

অভিযোগ ওঠার পর স্পষ্টভাবে বাসদের নারীকর্মীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যারা এখনও রাজনীতিতে আছেন, তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশে কীভাবে নেতৃত্ব পেয়েছেন, সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি বাসদের নেতাদের নামে কী ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে নানা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। বাসদের নারী উইং ‘সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম’র সাধারণ সম্পাদক দিলরুবা নূরী তার ফেসবুকে সারা দেশের অন্তত ১১ নারীনেত্রীর নেতৃত্বে আসার লড়াইয়ের কথা তুলে ধরে লেখেন, ‘এই নারীরা বাসদের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না পেলে নেতৃত্বের জায়গায় কি আসতে পারে?’

এ পরিস্থিতিতে বাসদের কোনও কোনও কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন এবং যৌন শোষণের একাধিক অভিযোগ ওঠার পর ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয়ভাবে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়। যার মূল বক্তব্য— যৌন নিপীড়নের অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ ছাত্রফ্রণ্টের কেন্দ্রীয় কমিটির পদত্যাগকারী সাধারণ সম্পাদক শোভনের বক্তব্যকে বলা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সূত্র বলছে, ওই প্রেস রিলিজে সই করেছেন দুই জন নারীকর্মী— মুক্তা বারৈ এবং সুস্মিতা মরিয়ম। সুস্মিতা মরিয়মকে মাত্র গত সপ্তাহে নতুন নিয়োগ দিয়ে ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।

কথা হয় অভিযোগ উত্থাপনকারী শোভনের সঙ্গে। তিনি জানান, কীভাবে গত নভেম্বরের পর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন।

শোভন রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি যখন এ ধরনের যৌন নিপীড়নের বিষয়ে জানতে পারি, তখন পার্টিকে জানিয়েছি। আমাকে বারবার বলা হয়েছে, আমি নাকি ভুল বুঝেছি। আমাকে বলা হয়েছে— আলাপ করতে হবে পার্টির ভেতরে, বাইরে নয়। এরপর চলতি মাসে (জুন) ৪ থেকে ৬ তারিখ ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং। সেখানে অভিযুক্ত বজলুর রশিদ ফিরোজের সামনে যদি অভিযোগকারীদের বলতে বলেন— কী হয়েছিল, তারা বলবেন? অভিযুক্তকে এভাবে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়?’

এই নারীরা কেন মুখ খোলেন না, বা তারা কেন পার্টি ছেড়ে যান না প্রশ্নে শোভন বলেন, ‘শুরু থেকে এমন নারীদের টার্গেট করা হয় যাদের বয়স কম, সহজে আকর্ষণ বোধ করেন যারা, যারা মানসিকভাবে দুর্বল। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন যে, সব সময় ক্যালকুলেশন কাজ করে না। কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও বেঁকে বসতেই পারেন।’

বাসদের রাজনীতি ছেড়ে চলে গেছেন— এমন একজন জ্যেষ্ঠ নারীকর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখন যা যা সামনে আসছে, তা সবই সত্য তথ্য। বাসদ ছেড়ে আমি অন্য কোনও দলে যোগ দেইনি। তাহলে আমি কেন বাসদ ছাড়লাম? যতদিন রাজনীতি করেছি, ততদিন দেখেছি— ছলে বলে কৌশলে নারীদের হেনস্তা করা করে কিছু ক্ষমতাবান নেতা।’ কেন নিপীড়নের শিকার নারীরা মুখ খোলেন না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সামাজিক টানাপড়েনের কারণে মুখ খোলে না, কিন্তু দল ছেড়ে চলে যায়। অনেকে যারা দল ছেড়ে গিয়ে এখন সংসার করছেন, তারা কি বলতে চাইবেন তাদের সঙ্গে কী ঘটেছিল? আর কার কাছে অভিযোগ করবেন? নেতাদের কাছে বলে আজ পর্যন্ত কোনও সুরাহা পাওয়া যায়নি। নেতাদের বলতে শোনা গেছে— প্রেম না করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চাহিদা মিটিয়ে, সেটা ভুলে যেতে হবে। এসব তারা শেখানোর চেষ্টা করে মূলত গ্রাম থেকে আসা নারী কর্মীদের। আমরা যারা দল করেছি, তারা এই বিষয়গুলো নিজ কানে শুনেছি বলেই এখন যারা অভিযোগ তুলছেন, তাদের অবিশ্বাস করছি না।’

ফেসবুককেন্দ্রিক অভিযোগ আসা ১০ দিন পার হয়ে গেলো, দল এ বিষয়ে কিছু ভাবছে কিনা জানতে চাইলে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাংগঠনিক বিবেচনায় যেটা করার আমরা সেটাই ভাবছি। অভ্যন্তরে আলোচনা, কর্মীদের জিজ্ঞাসা— এ সবের মধ্য দিয়ে আমরা বিবেচনা করে দলীয় বক্তব্য হাজির করবো। আমি এখন ঢাকার বাইরে আছি।’

এত অভিযোগ সামনে আসছে,এর কোনোটাই আগে কখনও কানে এসেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ তো দেখছি না। দেখছি নানা বক্তব্য,মন্তব্য এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও দিয়ে দিচ্ছে। অভিযোগের ক্ষেত্রে তো ভ্যালিড গ্রাউন্ড থাকতে হয়। যেসব বিষয় সামনে আসছে, সব বিবেচনা করে আমরা আমাদের অবস্থান জানাবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *