নিম্ন ও মধ্যবিত্তের লড়াই আরও কঠিন হয়ে গেল

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অংকের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত থাকায় এনবিআরকে এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তিনি। রাজস্ব আদায়ের ছক কষতে গিয়ে পরোক্ষ করের পরিমাণ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আরও চাপে ফেলেছে এনবিআর। আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য যার করযোগ্য আয় নেই, তাকেও কর পরিশোধে চেপে ধরেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে সংসার খরচ বাড়ছেই। এই পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবেÑ তা জানতে বাজেটের দিকে চোখ ছিল অনেক মধ্যবিত্তের। চেয়েছিলেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। ভেবেছিলেন নির্বাচন উপলক্ষে হয়তো জনতুষ্টির কথা ভেবে অর্থমন্ত্রী নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে হতাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের চাপে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে নিত্যপণ্যের ওপর করারোপ করেছেন। তাতে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। অন্যদিকে স্বস্তি দিয়েছেন ধনীদের। ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জের ক্ষেত্রে আবার ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতদিন তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলেই সারচার্জ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আগামী বছরের বাজেটে এ সীমা বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাব অনুযায়ী, নিট সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে হলে ওই ব্যক্তির করের ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে কিংবা নিজ নামে একাধিক গাড়ি কিংবা ৮ হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের গৃহ-সম্পত্তি থাকলেও ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে। এ ছাড়া নিট সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে হলে প্রদত্ত করের ২০ শতাংশ; সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে হলে করের ৩০ শতাংশ এবং ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে করের ৩৫ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তি সারচার্জ দিয়েছেন। ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সারচার্জ দেওয়ার বিধান করা হয়। তখন অবশ্য দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হতো।

আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা ওয়েলথ এক্সের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। ওই সময়ে দেশে ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদধারী ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, কর বিবরণীর প্রমাণপত্র পেতে করদাতাকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। সব মিলিয়ে ৪৪ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে। তাদের এখন এসব সেবা পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এর অর্থ হলো পেনশনভোগী এবং গৃহিণীসহ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের আয় বছরে সাড়ে ৩ লাখ টাকার কম হলেও তারা ন্যূনতম করের আওতায় আসছেন। প্রস্তাবটি

এমন সময়ে করা হলো, যখন দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমনÑ কলম, তৈজসপত্র, রূপচর্চা সামগ্রী, রান্নার এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকার, বাড়ি নির্মাণসামগ্রী সিমেন্টের দাম বাড়বে। কলম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে কলমের দাম বাড়তে পারে। আবাসিকে গ্যাস সংকট থাকায় এখন এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সেখানে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এলপি গ্যাস উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিলিন্ডার বানানোর কাজে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পণ্যের ভ্যাট বাড়ালে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবেই। কারণ চূড়ান্তভাবে ক্রেতাকেই ভ্যাটের ভার বহন করতে হয়। ভ্যাট হার না বাড়িয়ে ফাঁকি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া গেলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যেত। এতে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ পড়ত না।

রাজস্ব আয়ের সহজ পন্থা হিসেবে প্রতি অর্থবছর সিগারেটের মূল্য বাড়ায় এনবিআর, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কফিমেট আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। তাই পণ্যটিরও দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে।

বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিল, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ও তৈজসপত্রের ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে প্লাস্টিকের থালাবাসন, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিলের দাম বাড়তে পারে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বাড়তে পারে খেজুর ও বাদামের দামও।

রাজস্ব আদায় বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তাই মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।

নতুন বাজেটে আকাশপথে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে। এতদিন দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ কর দিতে হতো না। এ ছাড়া ভ্রমণ কর বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে স্থলপথে বিদেশ গমনে ৫০০ এবং নৌপথে ৮০০ টাকা কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে ১ হাজার ২০০ টাকা কর ছিল, এটি বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। অন্য দেশ ভ্রমণে তিন হাজার টাকা কর ছিল, এটি চার হাজার টাকা করা হয়েছে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও তাইওয়ান ভ্রমণে যাত্রীপ্রতি চার হাজার টাকা ভ্রমণ কর ছিল, এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হয়েছে। সব ধরনের টিস্যুর দাম বাড়তে পারে। এর উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল, বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কার কথা খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও জানিয়েছেন। তবে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরাও শঙ্কিত। সারাবিশ্বেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না। একটা নমনীয় পথে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি (মূল্যস্ফীতি) হয়, তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী ছাড়ও দিচ্ছি।’

মধ্যবিত্তকে করের আওতায় আনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘মধ্যম মানের আয় করা অনেকেই কর দেন না, আপনারাই এ কথা বলতেন। সময় এসেছে তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফও বলেছে, কর দেওয়ার মতো ব্যক্তিদের কাছ থেকে যেন কর আদায় করা হয়।’

বাজেটে উচ্চবিত্ত সুবিধা পেলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে নিম্ন মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে। তারা জীবনধারণের জন্য যেসব পণ্য ক্রয় করে, সেগুলোর মূল্য সাধারণ মূল্যস্ফীতির চেয়ে দুই-তিনগুণ বেড়ে গেছে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের জন্য সামজিক সুরক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে আরও মানুষকে এর আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *