সম্মেলন ঘিরে দুই ধারায় জাতীয় পার্টি

Slider রাজনীতি


জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসে ফের বিভক্ত হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এক পক্ষে আছেন দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের)। আরেক পক্ষে আছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ; যিনি ইতোমধ্যে ৪২টি জেলায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেছেন। যদিও সম্মেলনের বিষয়ে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সামনে এসে বর্তমান ও ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে ধোঁয়াশায় পড়ে গেছেন নেতাকর্মীরা।

সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, জাপার মূল সংকট দেখা দেয় নির্বাচনী বছরে। অদৃশ্য সুতার টানে নানা শঙ্কা এসে দলের সামনে দাঁড়ায়। দ্বিধায় পড়ে যান নেতাকর্মীরা। ফলে দলটি তার অবস্থান থেকে এগোতে পারে না। জাপা নেতারা বলছেন, এবার সুযোগ ছিল ‘একাই’ কিছু একটা করার। কিন্তু নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থে সে সুযোগটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম।

রওশনপন্থিদের অভিযোগ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে জাপার নেতৃত্বে আসেন জিএম কাদের। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর ১৮ জুলাই দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন জিএম কাদের। জিএম কাদেরের ব্যাখ্যা ছিল, এরশাদ জীবদ্দশায় তাকে এ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। এ নিয়ে দলে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এভাবেই চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে ফের চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের। আর দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয় রওশন এরশাদকে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন কথা না হলেও গত আগস্টে থাইল্যান্ডে চিকিৎসারত অবস্থায় হঠাৎ দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে সম্মেলনের ডাক দেন রওশন এরশাদ। শুধু তাই নয়, থাইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় তিনি ভিডিও

কনফারেন্সে বক্তব্যও রাখেন। পরে অবশ্য ‘অজ্ঞাত’ কারণে সম্মেলন থেকে সরে যান রওশন। তখন জিএম কাদেরের সামনে আসে আইনি জটিলতা। কোর্টের নির্দেশে তিনি বেশ কিছুদিন দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালনের নিষেধজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ফের সম্মেলনমুখী হন রওশনপন্থিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা জেলা মহানগর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ বিভাগ, ময়মনসিংহ মহানগর জেলা, জামালপুর, ঢাকা বিভাগ, ঢাকা জেলা মহানগর উত্তর দক্ষিণ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, সিলেট বিভাগ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রাম মহানগর, কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, রাজশাহী বিভাগ, জেলা মহানগর, নাটোর, বগুড়া, চাঁপাইনবয়াবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর বিভাগ, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কক্সবাজার ও গাজীপুর মহানগরসহ ৪২টি সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটি দিয়েছেন রওশন এরশাদ। এসব কমিটিতে আছেন- দয়াল কুমার বড়ুয়া (চট্টগ্রাম), পীরজাদা সৈয়দ জুবায়ের আহমেদ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নাফিজ মাহবুব (ময়মনসিংহ), মেজর অবসরপ্রাপ্ত শিবলী মোহাম্মদ সাদিক (চাঁদপুর), মোহাম্মদ শামসুল আলম (কক্সবাজার), জাফর ইকবাল নিরব (পিরোজপুর), সালেহ চৌধুরী (সিলেট), আবু কাওসার খান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), গোলাম মোস্তফা পাটওয়ারী (চাঁদপুর), কাজী মোহাম্মদ নাসিরুল আলম (বান্দরবান), নাজমুল হক সিকদার (নরসিংদী), মোহাম্মদ মোর্শেদ সিদ্দিকী (চট্টগ্রাম), শহিদুল ইসলাম সালাম (চট্টগ্রাম), নিরাপদ তালুকদার (খাগড়াছড়ি), উদয়ন বড়ুয়া (রাঙামাটি), আবুল কালাম আজাদ (লক্ষ্মীপুর), ডা. সাইফুর রহমান (খুলনা) ও আসিফ আহমেদ মৃধা (চট্টগ্রাম)।

রওশনের অনুসারীদের কার্যক্রম সম্পর্কে জিএম কাদের আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি জানি, তারা আইনত জাতীয় পার্টি করতে পারে না। আমরা এসবকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না।’

দলের বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী জিএম কাদেরের দায়িত্বপালনের সময় পার হয় ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর। নির্বাচন কমিশন থেকে তাগাদা এলে তিনি করোনা মহামারীসহ নানা ইস্যু দেখিয়ে কিছুদিন সময় চেয়ে নেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনি নির্বাচন কমিশন থেকে দলীয় সম্মেলনের জন্য তিন মাসের সময় চেয়েছিলেন। তার সে সময়ও পার হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সারাদেশে সম্মেলনে করে ফেলব। এরপর কেন্দ্রীয় সম্মেলনের বিষয়ে ভাবব।’

দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘দলের সম্মেলনের কোনো ইঙ্গিত নেই, আভাসও নেই। নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা থাকলে হয়তো নামসর্বস্ব একটি সম্মেলন হবে।’ তিনি জানান, জেলা, থানা ও ওয়ার্ডেও সম্মেলন করার পরিকল্পনা নেই জিএম কাদেরের। দেশের আটটি ইউনিটে সম্মেলন করার কথা ভাবছেন তিনি।

রওশন বা তার অনুসারীরা দলের সম্মেলন করতে পারেন না- জিএম কাদেরের এমন বক্তব্যের বিষয়ে রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘জিএম কাদের অবৈধভাবে চেয়ারম্যান হয়েছেন। তারও মেয়াদ চলে গেছে। ফলে তার আর এখন দায়িত্ব পালনের বৈধতা নেই।’

এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও জাতীয় পার্টিতে সংকট দেখা দেয়। সে সময় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। নির্বাচনের পর আবার তা সমাধান হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট নেতারা মনে করছেন, অদৃশ্য সুতার টানে অনিশ্চিত ভাগ্যের পেছনে ছুটে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনের পর ফের অদৃশ্য সুতোর টানেই হয়তো একত্র হবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *