ঢাকা: সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় ঝুলে রয়েছে বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। ফার্স্টট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতাভুক্ত সোনাদিয়ার এ প্রকল্প নিয়ে চীন, নেদারল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ডেনমার্ক, জার্মানি ও ভারত আগ্রহ দেখালেও কারও বিষয়েই এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
নিয়ম অনুযায়ী সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) তৈরি করে দাতা দেশ-সংস্থা অনুসন্ধানে ইআরডিতে পাঠানো হয়। কিন্তু পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো দাতা দেশ, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সাড়া পাওয়া যায়নি বলে প্রকল্পটি জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি কোনো একটি বিশেষ দেশকে নয়, সম্মিলিতভাবে কয়েকটি দেশকে দেওয়ার কথা ভাবেছে সরকার। তবে কোনো কিছুই এখনও চূড়ান্ত নয়। আগ্রহী দেশগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর সিদ্ধান্ত যাচাই-বাছাই করার জন্য পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে সরকার। ইতোমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, ইআরডি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নৌ-পরিবহন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে।
এ বিষয়ে নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান বাংলানিউজকে বলেন, জি টু জি ভিত্তিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন, ভারত, নেদারল্যান্ডস ও দুবাইয়ের চারটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এসব প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ দিতে গত বছর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি বর্তমানে প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করছে। আশা করছি, খুব শিগগির কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। এর পর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের গভীরতা কম থাকায় বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। লাইটার জাহাজের সাহায্যে গভীর সমুদ্র থেকে পণ্য বন্দরে আনা হয়। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হলে চার হাজার টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে।
এ গভীর সমুদ্রবন্দরে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে তিন গুণের বেশি ৩০ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও ১০ কোটি টন বাল্ক কার্গো খালাস হওয়ার সক্ষমতা রাখা হবে বলে জানান তিনি।
মংলা বন্দরের আকরাম পয়েন্ট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আটটি সম্ভাব্য স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০০৯ সালে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল তাদের সমীক্ষা প্রতিবেদনে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সুপারিশ করে।
এছাড়া, পটুয়াখালীর পায়রা মোহনায় আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। পায়রার বন্দরটি নির্মাণের কার্যকারিতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। ব্রিটেনের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান ওয়েলিং ফোর্ড গত ফেব্রুয়ারি থেকে সমীক্ষার কাজ শুরু করেছে। আগামী অক্টোবর নাগাদ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
এ বন্দরটি নির্মাণেও চীন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস প্রস্তাব দিয়েছে। চীন ও নেদারল্যান্ডস যৌথভাবে প্রস্তাব দিলেও চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে জি-টু-জি প্রস্তাব।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকটি দেশ এ সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখালেও সরকার এখনও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
এদিকে হঠাৎ করে সোনাদিয়ার দিক থেকে নজর সরিয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে পায়রাতে গুরুত্ব দেওয়ায় ভিতরে বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে সরকার সোনাদিয়ার থেকে মনোযোগ সরিয়ে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করছে। এটা দেশের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, সোনাদিয়া আর পায়রার সম্ভাব্যতা সমান নয়। গভীর মুদ্র বন্দর বলতে যা বোঝায় তা শুধু সোনাদিয়াতে সম্ভব। যেখানে বিদেশি জাহাজগুলো কোনো অসুবিধা ছাড়াই নোঙর করতে পারবে। অথচ পায়রার দীর্ঘ এলাকা স্থল অংশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় সে জাহাজগুলো থেকে মালামাল পরিবহন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হবে।
জানা যায়, সর্বশেষ সম্ভাব্যতা যাচাই অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন ২২৩ কোটি ডলার। বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে ৪৩ বছর মেয়াদী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ৫৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। তিন পর্যায়ে এ বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ করার লক্ষ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর সেল গঠন করা হয়। নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ তিন ধাপে পরিপূর্ণভাবে ২০৫৫ সালে শেষ হওয়ার কথা।
সূত্র জানায়, ভারত ও চীন একই সঙ্গে আগ্রহ দেখানোয় কিছুটা ধীরে চলো নীতি নেয় সরকার। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে এ বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উঠেছিল কি না সে বিষয়ে কোনো পক্ষই পরিষ্কার করেনি। তবে ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে মোদির কাছে বিষয়টি তোলা হয়।
বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেন, আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব রেখেছিলাম। তিনি বিষয়টা শুনে মুচকি হেসেছেন।
বর্তমানে ডাচ বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী লিলিয়ান প্লুমেন এবং অবকাঠামো ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী মেলানে সুলজ ভ্যান হেগেন। আলোচনায় তারাও নেদারল্যান্ডসের প্রস্তাব বিবেচনার ওপর জোর দিয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে, আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা আসার কথা রয়েছে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। সেই সফরের আগে বিসয়টি আরও একবার আলোচনায় উঠবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।