উপায় হোসেন গোলাম নাই

Slider সম্পাদকীয়


ঢাকা: ছোটকালে গ্রামে যাত্রাপালা বা পালাগান শোনা যেত। কাজ কাম সেরে এসব গানে রাতের বেলায় মানুষ হুমড়ি খেত। সময়টা এমনভাবে তৈরী হয়েছিল যে, পালাগান বা যাত্রাপালার দিনে গানের ভ্যানু এলাকার লোকজন তাদের মেয়ে বউদের দাওয়াত দিত, গান শোনার দাওয়াত। স্বপরিবারে এই সব পালাগান শোনা হত অনেক মজা করে। বিশেষ করে শীতের দিনে এই সব অনুষ্ঠান বেশী হত। গানের রাতে চাদরে শরীর ঢেকে অচেনা মানুষের মত দলে দলে গান শোনতে যেত সকল চেনাজানা মানুষ। গানের আগে ও পরে উৎসব হয়ে থাকতো প্রতিটি পালা গান। পালাগান, কবি গান, বাউল গান, নাটক ও যাত্রাপালা গ্রামীন সংস্কৃতির একটি অনবদ্য অলংকার ছিল। কিন্তু আজকের এই সময়ে চিরায়ত গ্রামীন সংস্কৃতি হয়ে যাচ্ছে বোকাদের সংস্কৃতি। শহুরের মানুষগুলো গ্রামের মানুষের এই সংস্কৃতিকে গেরাইম্মা গান বলে টিস করে এখন।

সময়ের যাতাকলে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীন উৎসব এখনো সংস্কৃতিসেবীদের কাছে সেরা উৎসব। যশ ও খ্যাতী পাওয়া আজকের সেলিব্রেটি শিল্পীরা প্রায় সকলেই মঞ্চনাটক থেকে তৈরী। এখনো নামীদামী শিল্পীরা দেশে-বিদেশে মঞ্চে অনুষ্ঠান করেন। তবে নামটা পাল্টানোর চেষ্টা করে ষ্ট্যাজ প্রোগ্রাম রাখা হয়েছে। বাংলায় বললে অবশ্য মঞ্চ শব্দটা বিদায় করা যাবে না। যেই লাউ সেই কদুর মত অবস্থা। ষ্ট্যাজ প্রোগ্রাম বা মঞ্চ অনুষ্ঠান একই কথা। গ্রামে হলে গ্রামীন সংস্কৃতি আর শহরে হলে ষ্ট্যাজ প্রোগ্রাম।

ছোটকালের একটি কথা মনে পড়ে গেলো। আমার এক চাচা নাটকে অভিনয় করতেন। একবার মঞ্চে উঠে একটি ডায়লগ বলতে গিয়ে ভুলে উল্টো হয়ে গিয়েছিল। তাৎৎক্ষনিকভাবে হাসির বন্যা বইয়ে গেলে সাথে সাথে ডায়লগটি ঠিক করা হয়েছিল। ডায়লগটির আসল বাক্য ছিল, উপায় নাই গোলাম হোসেন। কিন্তু আমার চাচা বলে ফেলেছিলেন উপায় হোসেন গোলাম নাই।

অনেক আগেকার এই বাক্যটি শ্লিপ অব টাং হলেও আজকের দিনে এটাই সত্য বলে মনে হচ্ছে। কারণ বাস্তবতা বলছে, আগেই আমরা ভালো ছিলাম। ৩০/৪০ বছর আগে আমাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন মজবুত ছিল। রাজনীতির কথা মানুষ জানত কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতার দেখা পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের। আজকের বাস্তবতা বলছে, বেশী পেয়ে পেয়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজেদেরই প্রায়।

বাস্তবতা বলছে, আগেকার সময়ে ছেলেরা ধুমপান করত জঙ্গলে বসে বা মুরুব্বীদের আড়ালে। কিন্তু আজ মুরুব্বীদের দিয়ে সিগারেট বা মদ কিনে এনে খায়। এমন বাবার দেখা মিলেছে, যে বাবা শখ করে সিগারেট কিনার সময় বলছেন, বাহাদুর ছেলে আমার। দামী সিগারেট খায়। কি যে করি, আর পারি না।

সময় বদলেছে। বদলেছে নীতি নৈতিকতার। আদর্শ এখন ব্যবসার পুঁজি। দেশপ্রেম এখন সাইনবোর্ড। পারিবারিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আচার আচরণ আমাদের চিরায়ত সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে অনেক আগেই। এ যুগে আমরা একটি অন্ধকার সময় অতিক্রম করছি। রাষ্ট্রের মালিক জনগন এটা কাগুজে লেখা। বাস্তবে তা নেই বললেই চলে। কারণ আমাদের কর্মচারীদের স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। আমাদের কর্মচারীরা বিলাসবহুল উঁচু ভবনেও ঘুমায় আর আমরা নদীর পাড়ে, বিলে দ্বারে, রেল ষ্টেশনে বা বাসষ্ট্যান্ডেও ঘুমাই। মূর্খ লোকও চাকুরী করে আর রাষ্ট্রের মালিক শিক্ষিত লোক তার জুতা পরিস্কার করে দেয়। এটাই আমাদের প্রাপ্তী মনে করছি আমরা। এক সময় চৌদ্দ পুরুষে কোন কালি থাকলে ওই বংশ থেকে কেউ জনপ্রতিনিধি হওযার জন্য দাঁড়াতেই পারত না। আর আজ জীবনে সবচেয়ে বেশী কালি থাকা মানুষ বেশী যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। মানুষ টিভি দেখে পত্রিকা পড়ে নেতাদের যেসব কথা জানছে তার মধ্যে কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক এটা জনগন ও বক্তারাও জানে। তারপরও বলছে আর শুনছে, এই রীতিই চলছে। জোর যার মল্লুক তার এই রীতই এখন নীতি হয়ে যাচ্ছে।

ইতিহাস বলছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগনকে কখনো অন্যায়ভাবে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে টেনে হিচড়ে জেলে ঢুকানো হয়। ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় প্রিয়জনের ফেরার আশায়। এই আশা জীবিত বা লাশের আশাও হয়ে যায়। কখনো এমন আশা করতে করতে আশাবাদী মানুষ মরেও যায়। অদৃশ্যে থাকা মানুষের সন্তান, স্ত্রী, বাবা কিংবা মা কাগজে লিখতে গেলে অনুপুস্থিত ব্যাক্তিকে মৃত না জীবিত লিখবে তার ফয়সালা করতে করতে মৃত্যুই হয়ে যায়। ধর্মীয় মতে মুসলমান পুরুষের মৃত্যু হলে স্ত্রী নাক ফুল খুলে ফেলেন ও সাদা শাড়ি পরেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সিঁদুর মুছে ফেলতে হয়। কিন্তু নিখোজ ব্যক্তিদের স্ত্রীরা স্বামীকে জীবিত না মৃত মনে করবে সেটা সিদ্ধান্ত না থাকায় কঠিন ধর্মীয় ঝামেলায় পড়ে থাকে। নিঁখোজ ব্যক্তিদের সন্তানেরা লেখাপড়ার সময় বাবা মৃত না জীবিত সেটা বলতে পারে না। এই অবস্থা একটি সভ্য সমাজের জন্য অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না। মানুষ এই ধরণের অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়।

তৃনমূলের একটু বিবেচক মানুষেরা বলছেন, সরকারের কাছে আমাদের তেমন কোন চাওয়া নেই। ন্যায় বিচার দিয়ে নিরাপদে রাখলেই হল। ভোটের বিষয়ে তারা বলছেন, ভোট দিতে গিয়ে হতাহত বা গ্রেফতার না হলেই হয়। ভোট না হলে নাই কিন্তু ভোটের কথা বলে রক্তাক্ত করে দেয়া বা জেলে নিয়ে যাওয়া, লাশ হয়ে ফেরা, এই সব চাই না আমরা। একজনকে ভোট দেব অন্যজন পাশ করবে এমন ভোটে আমাদের না ডাকলেই খুশি আমরা। সুন্দর ভোট ও সুন্দর ফল দিতে না পারলে ডেকে নিয়ে ভোটারের ১২টা বাজানোর কি দরকার।

সাধারণ মানুষ বলছেন, রাজনীতি ঘরে ঘরে পৌছে গেছে। সুখ দুঃখের যে কোন অনুষ্ঠানেই এখন রাজনীতি। এমনকি জানাজার নামাজেও রাজনীতি। ঘরে বাইরে মাঠে ময়দানে যে কোন অনুষ্ঠান করার আগে ক্ষমতায় থাকা দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি নিয়ে নিতে হয়। জানাজার নামাজেও কারা কারা বক্তব্য রাখবেন তাদের নামও রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত করে আসতে হয়। এই রীতি প্রায় দুই যুগ সময়ের।

পরিস্থিতি বলছে, দিন দিন আমরা নিজেদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন দিন দিন হালকা হচ্ছে আমাদের। সামগ্রিকভাবে আমাদের বন্ধন হালকা হওয়ার কারণে নতুন নতুন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এই সকল অপরাধ আমাদেরকে আলাদা আলাদা করে দিচ্ছে। পরিত্রান না হলে পরিস্থিতি আমার চাচার ভুল ডায়লগের মতই হয়ে যেতে পারে। উপায় হোসেন গোলাম নাই।

লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *