‘এ-যুগে শুনছি, রটায় সবাই, হৃদয় থাকাটা বিপজ্জনক;’ [কবি শামসুর রাহমান]
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন সাড়ে ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ তো দাপ্তরিক হিসাব। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃত হিসাবে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হবে। বিপুলসংখ্যক আশ্রিত রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার এখন বদলে যাওয়া এক জনপদ। যত দিন যাচ্ছে, স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় রোহিঙ্গার সংখ্যা ততই বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয়রাই একসময় সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে; হয়ে যাবে নিজভূমে পরবাসী। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘কতবার ভাবি’ কবিতায় কবি শামসুর রাহমান যথার্থই বলেছিলেনÑ হৃদয় থাকাটা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই হয়েছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাই এখন বিপজ্জনক বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে স্রেফ আলোচনাতেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, ৯টি উপজেলা মিলিয়ে কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ২৩ হাজার ২৬৫ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৪০ জন, চকরিয়া উপজেলায় ৫ লাখ ৭১ হাজার ২৭৭ জন, পেকুয়া উপজেলায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৭ জন, কুতুবদিয়ায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬২২ জন, মহেশখালীতে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৭ জন, রামুতে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৫ জন, উখিয়ায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ জন, টেকনাফে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৩ জন এবং ঈদগাঁও উপজেলার জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৬। এদিকে স্রেফ উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতেই সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৯০টি শিশু। বিপুল এই জনস্রোতের পরিসেবা জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ক্রমাগত অপরাধকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, আশ্রয় পাওয়ার পাঁচ বছর পর এখন বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমন আচরণ করছে যেন তারাই এখানকার প্রকৃত অধিবাসী। কারণ উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের চাপে কৃষিজমি, শ্রমবাজার ও শিক্ষাসহ ওই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনের নানা দিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয় মানুষজন ও উন্নয়নকর্মীরা জানাচ্ছেন। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে। সার্বিকভাবে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হয়ে বসা রোহিঙ্গাদের সন্তান জন্মদান বেড়েই চলছে। নানা রকম প্রচারের পরও জন্মনিয়ন্ত্রণে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। গেল পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ লাখের বেশি শিশু জন্মলাভ করেছে। যদিও ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গেল নভেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। বর্তমানে ক্যাম্পে বসবাসকারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশেরও বেশি রোহিঙ্গার বয়স আঠারোর নিচে। গড়ে প্রতিদিন ৯০টি শিশু জন্মানোর পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে একাধিক বিয়ে ও বাল্যবিয়ের প্রবণতা কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। অধিক সন্তান জন্মদানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলেও এসবের প্রভাব পড়ছে না তাদের মানসজগতে।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ১০ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এজন্য এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই রয়েছে স্থানীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতি ও চাষযোগ্য জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ কারণে অনেকের ভিটেবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চাষাবাদের জমি অঘোষিতভাবে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজন। একইভাবে শ্রমবাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়ায় নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৩২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের অপতৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে সশস্ত্র জঙ্গি রয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক। আর তাদের নিরস্ত্র সমর্থক রয়েছে লক্ষাধিক। খোদ এক রোহিঙ্গা নেতাই এমন তথ্য দিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে। ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশই খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক পাচার, চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িত। অপরাধের আখড়ায় পরিণত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ড্রোন ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ার বসিয়ে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। কিন্তু এত সব নজরদারির মধ্যেই গত পাঁচ বছর পাঁচ মাসে ১৩৬ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, মামলা হয়েছে ৫ হাজার ২২৯টি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে মে মাসে দেশব্যাপী শুরু মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন, যার মধ্যে তিনজন নারীও ছিলেন। শুধু নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি নয়, রোহিঙ্গাদের হামলায় এ পর্যন্ত ১১ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। পাশাপাশি অপহরণকাণ্ডও ঘটছে প্রায়ই। শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি কত দিন নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, এ নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয়রা। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে যত দেরি হবে, ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ততই খারাপ হবে বলে মনে করছে সচেতন মহল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শরণার্থী শিবিরে সংঘাত, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন যেন স্বাভাবিক চিত্র।
রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু ক্যাম্পগুলোয় প্রতিবছর ৪৫ হাজার নবজাতক যোগ হচ্ছে। সেই হিসাবে পাঁচ বছর পাঁচ মাসে ক্যাম্পে যোগ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ৯ লাখ। কিন্তু এটিও যথার্থ হিসাব নয়। প্রকৃত অর্থে সংখ্যাটি ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কারণ গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, তারা এ হিসাবে আসেনি। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে দেখা গেছে, রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম, মাহিন্দ্র গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে, জেলেদের ফিশিং বোটে, বিভিন্ন প্রকার যানবাহনে ও ব্যবসাবাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কাজ এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফের স্থলবন্দরের অভ্যন্তরেও রোহিঙ্গারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। শুধু উখিয়া বা টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহরেও রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তবে পালংখালীতে ২৬টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এ কারণে জনভোগান্তি এখন অন্তহীন। তিনি আরও জানান, বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে বিভিন্ন সেবা ও শিক্ষাগ্রহণ থেকে স্থানীয়দের বঞ্চিত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। নাগরিক সনদ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ভোটার প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থানীয়দের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কারণ পালংখালীতে ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রয়োজন ৬৪ জন। কিন্তু শিক্ষক আছে ৩৩ জন। আগে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করা সম্ভব হলেও সেসব শিক্ষক এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিক্ষকতা করেন। ফলে স্থানীয়দের স্কুলে শিক্ষক সংকট দূর করা সম্ভব হচ্ছে না।
কক্সবাজার জেলা নাগরিক পরিষদের সভাপতি আবু নাসের মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাই রোহিঙ্গাদের কারণে নিজেদের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমন আচরণ করছে যেন তারাই এখানকার প্রকৃত অধিবাসী। ক্যাম্পগুলোতে জন্মহার এত বেশি যে, কয়েক বছর পর কক্সবাজারের স্থানীয়রাই এ জেলায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। কৃষিজমি, স্থানীয় শ্রমবাজার চলে যাচ্ছে আশ্রিতদের দখলে। এতে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম, মাহিন্দ্র গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে, জেলেদের ফিশিং বোটে, বিভিন্ন প্রকার যানবাহনে ও ব্যবসাবাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য কাজ এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গাদের অতি দ্রুত তাদের নিজ বাসভূম মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা জরুরি।