অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় কৃষি ও পল্লী ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা আছে ৮ শতাংশ। অথচ দেশের কৃষকরা এই সুদে ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংকগুলোর এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) নির্ভরতার কারণে গ্রামের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের ঋণ পেতে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকরা প্রকৃত অর্থে লাভবান হচ্ছেন, নাকি আরও ক্ষতির মুখে পড়ছেন- সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মধ্যে। তবে বিষয়টি নৈতিকভাবে এবং সাম্যতার ভিত্তিতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার নিজেও। গত মাসে দেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। এ অবস্থায় কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাতেই ‘ব্যাংক-এমএফআই লিঙ্কেজ’-এ কৃষিঋণ বিতরণের এ ধরনের ‘অসম’ সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়ে প্রতিবছর বেসরকারি ব্যাংকগুলো কৃষি খাতে বরাদ্দ ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ এনজিওদের মাধ্যমে বিতরণ করছে। আর সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে বরাদ্দের প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ। এক্ষেত্রে দেরিতে হলেও কৃষিঋণ বিতরণে বেসরকারি ব্যাংকের এনজিওনির্ভরতা কমাতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য এনজিও থেকে অভিজ্ঞ জনবল ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এই অভিভাবক প্রতিষ্ঠান
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদার নীতিমালার কারণে এনজিওর মাধ্যমে সহজেই কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যপূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ নীতিমালায় সুযোগ রাখার কারণেই নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকার পরও অনেক ব্যাংকই কৃষকদের সরাসরি ঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়। ফলে যাদের জন্য এই ঋণ কার্যক্রম, বেশি সুদের কারণে সেই কৃষকরাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের সব ব্যাংকের জন্য ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের জন্য ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এবারও বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক তাদের বরাদ্দের ৭০ শতাংশ ঋণই এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করছে। এর বাইরে সরকারি ব্যাংকগুলোও তাদের বরাদ্দের অন্তত ১০ থেকে ২০ শতাংশ এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করবে। এতে পুরো খাতে মোট বরাদ্দের ৬০ শতাংশের বেশি ঋণের জন্য কৃষককে চড়া সুদ গুনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এমএফআইর মাধ্যমে ঋণ দিলে সুদ একটু বেশি হবে। তবে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ কৃষকদের জন্য অনেক বেশি। এত বেশি সুদ নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তার পরও কৃষকরা এনজিওদের থেকে ঋণ নিতেই বেশি আগ্রহী। কারণ এখানে ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ফরমালিটিস (বাধ্যবাধকতা) থাকে না। এনজিওরা কৃষকের দৌরগোড়ায় ঋণটি পৌঁছে দেয়।
প্রায় একই অভিমত দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এনজিওদের সুদের হার একটু বেশি এ কথা ঠিক; তবে এনজিও থেকে ঋণটা পাওয়া যেমন সহজ, তেমনি ঋণটা নিয়ে কৃষক যথাযথ কাজেই ব্যবহারও করে। কারণ যখন যে ফসল, সেই ফসলের জন্যই ঋণটি দেয় এনজিওগুলো। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো থেকে কৃষকের ঋণ পাওয়া অনেক কঠিন।
দেশের সব ব্যাংকের জন্য কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়ে প্রতিবছর নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের নীতিমালায়ও বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে যাদের পল্লী অঞ্চলে শাখার সংখ্যা অপ্রতুল, তাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের (এমএফআই) সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোর যাদের পর্যাপ্ত শাখা (৫শর অধিক) রয়েছে, তারা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের (এমএফআই) সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতে কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। নীতিমালায় ব্যাংক সরাসরি কৃষকে ঋণ দিলে যে সুদ পাবে, একই সুদ পাবে এমএফআই প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিলেও। আর ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণ গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণের সুদের হার এমআরএ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমআরএ কর্তৃক এমএফআই প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষুদ্রঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা আছে ২৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের ফলে কৃষকদেরও ২৪ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। যদিও এই সুদের হার ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উঠছে। গত মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভার কার্যবিবরণী থেকেই এ তথ্য জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার নিজেই এমন তথ্য দিয়েছেন। ওই সভায় তিনি উল্লেখ করেন, কৃষি খাতে ব্যাংকগুলো মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ নিজেরা বিতরণ করে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করে। এনজিওগুলো ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ আরোপ করে। অর্থাৎ গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি সুদ প্রদান করে। বিষয়টি নৈতিকভাবে ও সাম্যতার ভিত্তিতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গভর্নর বলেন, কৃষিখাত হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক খাত। অর্থের মার্কেট শেয়ারের ৭৯ শতাংশ বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর হলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কৃষিখাতে ঋণের পরিমাণ মাত্র ২ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ। তাই ২০২৩ সালে কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করা হবে। কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না, বরং কিছু নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সভায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মো. মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো যখন এনজিওর মাধ্যম ছাড়া নিজেরাই কৃষিঋণ বিতরণ করবে, তখন তাদের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এনজিওকর্মীরা অভিজ্ঞ, কিন্তু তাদের বয়স অনেক ক্ষেত্রেই ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে। ব্যাংকগুলো ৩০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারে না। অন্যদিকে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বেতনের সীমা নির্ধারিত রয়েছে, কিন্তু এনজিওকর্মীদের বেতন তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র কৃষিঋণের জন্য বয়স ও ন্যূনতম বেতন শিথিল করে এনজিওতে কর্মরত অভিজ্ঞ জনবলকে ব্যাংকে নিয়োগ দিলে কৃষিখাত আরও গতিশীল হবে।
তবে আইএফআইসি ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও মিউচুয়াাল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডিরা এভাবে আলাদা আলাদা বেতন কাঠামোর পক্ষে ভিন্নমত পোষণ করেন। পরে সভায় শুধু কৃষিঋণের জন্য বয়স শিথিলপূর্বক এনজিওতে কর্মরত অভিজ্ঞ জনবলকে ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে ব্যাংক হতে আবেদনপত্র পাওয়ার পর তা বাংলাদেশ ব্যাংক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানানো হয়।