বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম একটি দেশ। আয়তনের বিচারে বিশ্ব মানচিত্রে এর অবস্থান ৯০তম। জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ অষ্টম বৃহত্তম দেশ। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর আরো ৫০ বছর পার করে ফেলেছে এই দেশটি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সেভাবে পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলেও বর্তমান বাংলাদেশ উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং ভূরাজনীতির আলোচনায় কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কাছে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ছিল মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতির মতো নেতিবাচক সংবাদের মাধ্যমে। এখনো আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভঙ্গুর নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি, সরকারি হুকুমতে গুম-খুনের বিষয় ব্যাপক আলোচিত। এত কিছুর পরেও ভূ-রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম।
বিশ্বরাজনীতির অন্যতম শক্তি চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে এ দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। কাজেই দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা যে পক্ষে থাকবে তার পাল্লা কিছুটা ভারী থাকবে এই পলিসি থেকে চীন এবং ভারত উভয়েই বাংলাদেশকে কাছে রাখার চেষ্টা করছে।
এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির কাছেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নানাবিধ সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকার পরও গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমাজকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কাঠামো এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার শর্ত থেকে আমরা শতগুণ পিছিয়ে পড়েছি। বর্তমানের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতান্ত্রিকতার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা, বিশেষ করে দুটি সাজানো জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা, বাক্স্বাধীনতার অভাব এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে সাধারণ জনগণের জিজ্ঞাসার ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন আন্তর্জাতিক মহলে অনেক অর্জনকেই ম্লান করে দিচ্ছে। একে অপরের শত্রুভাবাপন্ন ভারত ও চীন উভয় রাষ্ট্রই বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের মানসিক শক্তির জোগান দিয়ে যাচ্ছে।
অপর দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। র্যাব ও র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন দিয়ে সেই চাপের গতিকে বৃদ্ধি করেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশ, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার হিসেবে স্যাংশন দিয়ে থাকে। ১৯৯৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২০টিরও বেশি দেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। রাশিয়া ও চীনের কতিপয় ব্যক্তি, পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ওপরও মাঝে মধ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাব এবং তার সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে গত এক বছর আগে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাচাই বাছাই করে এই নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন দিয়েছে। এই স্যাংশন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের ওপর একধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারের ওপর কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। নির্বাচিত হয়ে একের পর এক বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমনপীড়ন ও অমানবিক নির্যাতনের ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে আসছে কিন্তু সরকার তাতে কোনো পরোয়া না করে আরো বেশি করে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গুম-খুন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল এবং এ ঘটনার সাথে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়মুক্তি পেয়ে আসছিল যা মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়ে সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্থগিত করার চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভোটবিহীন এবং জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে প্রায় ১৫ বছর দাপটের সাথে ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে ভারতের একচেটিয়া সমর্থন পেয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে চীনও এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছে অন্ধের মতো। বর্তমান সরকারও ভারতের পাশাপাশি ভারতের শত্রু রাষ্ট্র চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করার চেষ্টা করছে। চীনও এই সম্পর্ককে টেকসই করার জন্য বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও ঋণ দেয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সম্পর্ক বৃদ্ধির কারণ কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা নয়। চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের অন্য উদ্দেশ্যও রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক পরিসর সংকোচন নিয়ে যে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছে তাতে যদি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে চীনকে হাতে রাখার কৌশল হিসেবে চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার কৌশল নিয়েছে সরকার। কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ভারসাম্য নীতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে এই নীতি কতটা কার্যকর হবে তা সময় হলেই বুঝা যাবে।
অন্য দিকে চীন ও এ অঞ্চলে চীনের মিত্র পাকিস্তান, তাই বাংলাদেশের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে চীন ভারতের দুই দিকে মিত্রতার বলয় গড়তে পারবে ও ভারত মহাসাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, এমন আশা থেকেই চীন বাংলাদেশের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে চায়। কাজেই বাংলাদেশের এই অবস্থান যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা ভালো চোখে দেখবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়। মার্কিনদের আরেকটা ভয়ের জায়গা হলো, বাংলাদেশ যদি চীনের প্রভাব বলয়ে চলে যায় তাহলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো মিত্রই অবশিষ্ট থাকবে না। এসব বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে স্যাংশনকে বেছে নিয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিষয়ে পুরোপুরি ভারতকেন্দ্রিক নীতির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, যার কারণে তারা নিজেরাই বাংলাদেশ বিষয়ে উদগ্রীব। কৌশল হিসেবে বিনা ভোটের এই সরকারকে বিদায় করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কথা বলছে। এ অঞ্চলে পরাশক্তি চীনের আধিপত্য ঠেকাতে হলে ভারতকে শক্তিশালী করতে হবে। ভারতকে আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশকে কাছে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকা মনে করছে, দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকাশের বিপরীতে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন সৃষ্টি হচ্ছে, এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার নামে অনিয়ন্ত্রিত ও অনৈতিক বাণিজ্য। তাদের মতে, চীন ওই সব দেশে অনৈতিক অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলছে যার ফলে রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের যেমন বিকাশ ঘটছে না তেমনি অনৈতিক অর্থের কারণে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ও শক্তি চলে যাচ্ছে নীতিহীন কিছু লোকের হাতে। যে অর্থ শুধু ওই দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, অন্য দেশকেও করছে। এ কাজগুলো আমেরিকার সংজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত বা রুগ্ণ গণতন্ত্রের মধ্যে পড়ে। তারা এগুলো সংস্কারের জন্য স্যাংশনকে ব্যবহার করছে।
অতিসাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক চলার মধ্যেই ঢাকার রুশ দূতাবাস একটি ইঙ্গিতপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে, যাতে পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্লাকমেইল এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার’ অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে রাশিয়া পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সরকারের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের সমালোচনা করলেও চীন, ভারত ও রাশিয়া সেটি করেনি। আমরা যদি রাশিয়া ও চীনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করি, সেই দেশগুলোতেও একধরনের অথরিটারিয়ান (কর্তৃত্ববাদী) সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি চীন ও রাশিয়ার ওপর অনেকটা নির্ভার হয়েই আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আওয়াজকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কর্তৃত্ববাদী শাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। তবে দেখার বিষয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হয়।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে এখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য থাকলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের ভোটাধিকার স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা খুব বেশি প্রয়োজন। চীন এবং ভারতের ভূমিকা এই দেশের জনগণের সার্বভৌমত্বকে লুণ্ঠন করার শামিল। সে ক্ষেত্রে মার্কিন ভূমিকা জনগণের সার্বভৌমত্বকে ফিরিয়ে দেয়ার একটি প্রচেষ্টা। জনগণের উচিত, এই প্রচেষ্টাকে উদ্ধার করার যুদ্ধে শামিল হওয়া। নতুবা কর্তৃত্ববাদীর প্রসারতা গণতন্ত্রকে চিরতরে বিলীন করে উত্তর কোরিয়ার মতো একটি চিরস্থায়ী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে খুব বেশি সময় নেবে না।