মার্কিন প্রভাবে চিড় জাতীয়তাবাদী সালমানের হাতে বদলে যাচ্ছে সৌদি

সারাবিশ্ব

Mideast_Saudi_Arabia_bg_426965608
ঢাকা: চলতি বছরের শুরুর দিকে সালমান যখন সৌদি আরবের রাজ সিংহাসনে বসেন, তখন অনেকে ভেবেছিলেন, অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। কারণ, তিনি যখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন, তখনও অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছেন। বাদশাহর আসনে সালমান বসার পর সত্যিই পরিবর্তন এসেছে, অনেক বড় পরিবর্তন। ক’মাসের মাথায় পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে তিনি এমন পরিবর্তন আনলেন, একসময়ের যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর সৌদির জাতীয়তার সমালোচকরাও মুখে কুলুপ এঁটে গেলেন। ৭৯ বছর বয়সী সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ এখন সৌদি রাজত্বের প্রজন্মেরও পছন্দের শাসক হয়ে উঠছেন বলে প্রচার চলছে।

জানুয়ারিতে রাজত্বের মসনদে বসার পর প্রথমে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভাগগুলো ঢেলে সাজান সালমান। এরপর নিজের মসনদের ভিত মজবুত করে তিনি নজর দেন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতার তকমা ঘোচানোর দিকে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী ইয়েমেনে শিয়া সম্প্রদায়পন্থি হুথি বিদ্রোহীরা সুন্নিদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠলে তিনি মসনদে বসার মাস দেড়েকের মধ্যেই অর্থাৎ ‍মার্চে হুথিদের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। কেবল তা-ই নয়, স্বদেশের স্বার্থরক্ষায় সালমান সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরও সহযোগিতা বাড়িয়ে দেন। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর সৌদি আরবের এমন সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বকেই আলোড়িত করে।

জাতীয় নিরাপত্তায় বাদশাহর এ ধরনের পদক্ষেপকে যেমন স্বাগত জানানো হচ্ছে, তেমনি সালমানকে একজন দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণ ও সুদূরপ্রসারী নেতা বলেও তকমা দিচ্ছেন সৌদি নাগরিকরা। বিশ্লেষকদের মন্তব্য, এবার আর যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নয়, একজন জাতীয়তাবাদী নেতাই পেয়েছে সৌদি আরব।

সৌদির রাজকীয় আদালতের অবসারপ্রাপ্ত আইনজীবী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নাওয়াফ ওবাইদ বলেন, বিষয়টি কাঁচের মতো স্বচ্ছ। সৌদি আরব একজন দৃঢ় এবং যোগ্য নেতা পেয়েছে।

ওবাইদ স্মরণ করেন, বছর খানেক আগে তিনি যখন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন সালমান বলেছিলেন, আমরা যদি উদ্যোগী না হই, তবে অনেকেই আমাদের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। সালমান মনে করেন ‘পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ না করলে, পরিস্থিতিই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে’।

ওবাইদের মতে, ইসলাম ধর্মের পবিত্রস্থান মক্কা এবং মদিনার হেফাজত তার গুরুদায়িত্ব। আঞ্চলিক নিরাপত্তার চেয়েও এই নেতা সুন্নিদের নিরাপত্তায় যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা তার দূরদৃষ্টিরই পরিচয়।

বিশ্লেষকদের অভিমত, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এতদিন সৌদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু সে ছক উল্টে গেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সৌদিকে তার দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা বললেও রিয়াদ সম্প্রতি সরাসরিই ওয়াশিংটন-তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ে আলোচনা ও চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রশ্ন সেভাবে খণ্ডানোর কোনো চেষ্টা করেনি। অবশ্য ওয়াশিংটনের কোনো প্রতিক্রিয়াই সেভাবে কানে তোলার জায়গায় নেই রিয়াদ। রিয়াদকেন্দ্রিক সুন্নি জাতীয়তাবাদী বলয় গড়ে তুলছেন সালমান।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে রিয়াদের গভর্নরের দায়িত্ব পান আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজের ডজনখানেক সন্তানের মধ্যে বিচক্ষণতম সালমান।

১৯৬৩ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় তিনি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষকে সেবা দেন এবং আদিবাসী ও অবকাঠামোগত প্রকল্প হাতে নিয়ে দুর্নীতিমুক্ত রিয়াদ শাসনের ইতিহাস গড়েন।

সালমান ইতিহাস গড়ছেন কেন্দ্রীয় সিংহাসনে বসেও। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা শুরুর পর মুসলিম ধর্মীয় নেতারা তাকে জাতি ও প্রতিবেশীর ‘ডিফেন্ডার’ (রক্ষী) বলে আখ্যায়িত করছেন। সালমান স্বীকৃতি পাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের শাসক হিসেবেও।

তিনি ৫৫ বছর বয়সী অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী মোহাম্মেদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্স এবং ৭১ বছর বয়সী মুকরিন বিন আব্দুল আজিজকে ওল্ড প্রিন্স আখ্যায়িত করে নিজের ৩০ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মেদ বিন সালমানকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব দেন।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, ইয়েমেনে হামলার আগে এ বিষয়ে সালমান তার ছেলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তাকে ওয়াশিংটনে পাঠান ওবামার সঙ্গে দেখা করতে। আর এটা ছিল দীর্ঘদিন রিয়াদের ‘বড় ভাই’ সুলভ আচরণ করা ওয়াশিংটনের জন্য খুবই বিব্রতকর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন নেতৃত্ব মানেই উদার রাজনীতি করতে হবে এমন নয়। রাজা সালমান তার পরবর্তী প্রজন্মকে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের বাইরে যেতে মানা করেছেন। মানা করছেন সামাজিক আচার-রীতি ভাঙতেও। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও পশ্চিমা পোশাকের বিরুদ্ধে কঠোর হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বছরের এ কয়েক মাসেই সৌদি সরকার ৯০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রয়াত বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইরাক ও সিরিয়ার জিহাদীদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে কাউন্সেলিং প্রকল্প শুরু করলেও এতে কোনো কাজ না হওয়ায় কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন সালমান।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের পদক্ষেপে সৌদির রাজপরিবারের কোনো ধরনের বিপদের শঙ্কায় পড়তে হবে না। তবে, চরমপন্থিদের দমনে তাদের মার্কিন গোয়েন্দার সহায়তার দরকার রয়েছে। কারণ, লন্ডনভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থার মতে, ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার সৌদি সেনাকে তাদের দলে নিয়েছে চরমপন্থিরা। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সবচেয়ে ভাল ‍অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। অতএব, সালমান সৌদি’র রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে নামলেও তার মাথায় রাখা দরকার, কোনো কিছুই দ্রুত করা ভালো নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *