ফুটবল মহানায়ক ও আমার আর্জেন্টিনা

খেলা গ্রাম বাংলা টপ নিউজ বাংলার মুখোমুখি সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

10349227_634692073284618_6767354478006517010_n
গ্রাম বাংলা ডেস্ক: সেই ছোট্ট বয়সে যখন আমি হাফপ্যান্টের ভেতরে ডানলপ গেঞ্জি গুঁজে দিয়ে পায়ে বেলি কেডস পরে পুরোদস্তুর এ্যানজেলিক বেবি, সেই ছয়-সাত বছর বয়সে পাশের ঘর থেকে  শুনতাম মধ্যরাতের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি নামÑ ‘ম্যারাডোনা’;  সিনেমা হলে যেমন সুজাতা আজিম ফারুক কবরী রাজ্জাক ববিতাদের অসাধারণ অভিনয়শৈলী দেখতে মানুষের ঢল নামত, তেমনি ১৯৯০-এর রাতগুলোতে উপচে পড়ত পাড়ার মানুষ আমাদের আঙিনা ও ঘরে;  সেই প্রথম ম্যারাডোনা নামক ফুটবল জাদুকরের নাম শুনি এবং যথারীতি আমার রবিন হুড অথবা প্রমিথিউসের মতো অসম সাহসী আর মানবহিতৈষী বাবা বাছেদ সাহেবের কল্যাণে সেই যে ম্যারাডোনার প্রেমে পড়লাম, সেই প্রেম আমাকে অন্ধ করে ছাড়ল; অতঃপর অপদেবতা জিওস তুল্য ম্যাক্সিকান রেফারির (নাম মুখে আনতে চাই না) বিতর্কিত বিষের বাঁশি জার্মানিকে যখন জিতিয়ে দিল তখন সেকি আমার কান্না, সেই কান্নার জল মিশে গেল আর্জেন্টিনার প্লাতা নদীর জলে; তারপর ১৯৯৪ সালে বাতিগোল খ্যাত বাতিস্তুতা ও রেসের দাপুটে ঘোড়া ক্যানিজিয়াকে সারথী করে ম্যারাডোনা যখন কুরুক্ষেত্রের সঙ্কট কাটিয়ে গ্রিসের বিরুদ্ধে ৪-০ ও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ গোলের অসাধারণ জয় এনে দিলেন, গোটা বিশ্ব লুটিয়ে পড়ল যখন ফুটবল ঈশ্বরের অপ্রতিরোধ্য বা পায়ে, তখনি  কন্ট্রোল টেস্টের সুগভীর ষড়যন্ত্রে এফেড্রিন সেবনের অপবাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ৯৪ বিশ্বকাপ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হলো; অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ওষুধের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ মেশানো এফেড্রিনের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি পাওয়ারফুল এফেড্রিন স্বাভাবিক ওষুধ হিসেবেই গ্রহণ করে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবল খেলোয়াড়েরা। ম্যারাডোনা কাঁদলেন, নিষ্পাপ শিশুর মতো কাঁদলেন; কান্না পেলে তিনি কাঁদবেন না কেন? নিশ্চয়ই কাঁদবেন; তাঁর সঙ্গে কাঁদল গোটা পৃথিবী। তারও আগে নিখুঁত ড্রিবলিং, পাস, গতি ও গোলপোস্টে জ্যামিতিক মাপে অগ্নি গোলার মতো শটে ’৮৬-এর ম্যাক্সিকোর বিশ্বকাপে যা করলেন তিনি, মনে হলো স্বয়ং ঈশ্বর স্বর্গ থেকে এই মর্তে গোটা দুনিয়ার সকল অন্যায়-অসঙ্গতি, শ্রেণী-বৈষম্য, কালোবাজারী, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কর্তৃক থার্ড ওয়ার্ল্ডে শোষণ-নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার নিমিত্তে পাঠালেন এই বীর সেনানীকে, যে সেনানী কখনো অর্জুন, কখনো হামযা, কখনো খালিদ, কখনো হুচি মিন, কখনো চে, কখনো ক্যাস্ট্রো, কখনো লেনিন হয়ে লড়ে যাবেন সকল অপগ্রহ আর কৃষ্ণপক্ষের বিরুদ্ধে; সকল অশুভের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য ঈশ্বর তাঁকে উপহার দিয়েছেন দুটি পা ও একটি মাথা, পা ও মাথার সঙ্গে আমৃত্যু বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করে দিয়েছেন ফুটবলকে। ফকল্যান্ড যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টিনার জাতশত্রু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড়ে ছয়জন ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে গোলকিপার শিলটনকে পরাস্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি যে ফুটবলের কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যটি লিখলেন তাতেই স্বর্গের ফুটবল দেবতার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল পৃথিবী নামক গ্রহ; এমনকি সেমিফাইনালে সেই একই বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে অদমনীয় নয়নাভিরাম আক্রমণ ব্যূহকে কি ভুলে যাওয়া যায়? অতঃপর বেলজিয়ামের সকল প্রতিরোধ ও প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি যে গোলটি করলেন তাতেই ফুটবল সাম্রাজ্যে তিনি তার স্বীয় আসনটিকে চিরকালের জন্য নিজের করে পেলেন, মুকুটহীন সম্রাট হয়ে শাসন করবার ভার পেলেন আমাদের মতো ফুটবলের সৌন্দর্যের পূজারীদের, সে শাসনে আবেগ অনুভূতি আর ভালোবাসাটাই পুঁজি; এমনকি অন্যান্য হিসাব বাদ দিয়েই এক ’৮৬ই তাঁকে ফুটবল সাম্রাজ্যের আসনটি এমন ভাবেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে দিল, যার বদৌলতে তার আগেকার ত্রুটিকে, পেলে, দি স্তেফানো ও পুস্কাসের মতো সম্রাটেরা ম্লান হয়ে গেল। সেই ম্যারাডোনার প্রেমে যখন এতই পাগল আমি, ঠিক তখনই জানলাম আমার বহু আগেই আমাদের কবিগুরু শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ম্যারাডোনার দেশের বিদুষী যুবতী বুয়েন্স আয়ার্সের তিলোত্তমা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে ভালোবেসে ৩১ মার্চ, ১৯২৫ খ্রী. চিঠিতে লিখেছেনÑ ‘আমার মন চলে যায় সান ইসিদ্রোর সেই বারান্দাটিতে। স্পষ্ট এখনো মনে পড়ে সকাল বেলার আলো ভরা বিচিত্র লাল-নীল ফুলের উৎসব। আর বিরাট সেই নদীর ওপর নিরন্তর রঙের খেলা, আমার নির্জন সেই অলিন্দ থেকে অক্লান্ত সেই চেয়ে দেখা।’ তাহলে আমি আর এড়াই কি করে আর্জেন্টিনা আর কিংবদন্তির ফুটবল মহানায়ক ম্যারাডোনাকে, এড়াই কি করে তাঁরই যথার্থ উত্তরসূরী ভিন্ন গ্রহের খেলোয়ার গ্রেট মেসিকে? আশা করছি রক্ষণভাগের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ফুটবল যাদুকর মেসি দ্য গ্রেট অপর নক্ষত্র ডি মারয়িা হিগুয়েইনদের নিয়ে ম্যাক্সিকোকে ছাপিয়ে ১৯৮৬ এর ফুটবল মহাকাব্যের বাকি ভিন্ন ইপিসোড ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলে সাম্বা নৃত্য ও পেলের দেশ ব্রাজিলে লিখবেন, সেই সঙ্গে হয়ে উঠবেন কালোত্তীর্ণ ফুটবল মহাকবি, যা তাঁকেই মানায়; আর আমরা যারা ফুটবল অন্ত:প্রাণ মানুষ, এমনকি ফুটবল বোদ্ধা তাঁরা এই মহাকাব্যের পাঠ নেবো মুগ্ধ হয়ে।

লেখক: কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *