বাধা পেরিয়ে জনস্রোত

Slider রাজনীতি


বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে বিপুল লোক সমাগম ঘটিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা খুলনায় গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। সমাবেশমুখী স্রোত ‘ঠেকাতে’ গণপরিবহন ধর্মঘট, গ্রেফতার, হুঁশিয়ারি কার্যত কোনোটাই কাজে আসেনি। আগের দিন রাত থেকে নেতা-কর্মীদের যে ঢল নামতে শুরু করে তা গতকাল দুপুরে সমাবেশ শুরুর আগেই জনসমুদ্রে রূপ নেয়। ১২৭ বর্গ কিলোমিটারের খুলনা মহানগরী পরিণত হয় জনতার নগরে। সমাবেশ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, শত বাধা দিয়েও পতন ঠেকানো যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানো হবে।

বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার খুলনায় সমাবেশ করে বিএনপি। গত কয়েক দিন ধরে এই সমাবেশের দিকে নজর ছিল সবার। কারণ সমাবেশ ঘিরে আচমকা পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় নৌযান, ফেরি ও খেয়া। খুলনা মহানগরীর প্রবেশপথে ছিল সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র মহড়া। খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় চলেছে পুলিশি অভিযান। এমন পরিস্থিতি সামলে কয়েক লাখ লোকের উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে বিএনপি। জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে পাঁচ নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ কয়েক দফা দাবিতে এ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর ডাকবাংলা মোড়ের সোনালী ব্যাংক চত্বরে সমাবেশের মঞ্চ করা হলেও আশপাশের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা ছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলে। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই সমাবেশস্থল কানায় কানায় ভরে যায়। ছিল না তিল ধারণের জায়গাও। সমাবেশ স্থানের উত্তরে ফেরিঘাট, পূর্বে জেলখানা ঘাট এবং দক্ষিণে শান্তিধাম মোড় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। তাদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি সম্বলিত স্লোগান নিয়ে সমাবেশে আসেন সবাই। কারো হাতে লাঠিসোটা ছিল। কেউ কেউ জাতীয় পতাকা মোড়ানো লাঠি নিয়েও এসেছিলেন। শহরের বাইরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের লাঠি, গজারি ও রামদা নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। তবে পুরো শহর ছিল বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে সরব। দুপুর পৌনে ২টায় সমাবেশের মঞ্চে আসেন প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তত্ত্বাবধায়কে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ১০ আসনও পাবে না : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের চিহ্ন থাকবে না। নির্বাচনে তারা ১০ আসনও পাবে না। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়েছিল বিএনপি। ২০১৮ সালে নিশিরাতে ভোট হয়ে গেছে। দুই নির্বাচনেই কেউ ভোট দিতে পারেনি। ২০২৩ সালে নির্বাচন আসছে। এবারও ক্ষমতাসীনরা একই কায়দায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার পাঁয়তারা করছে। এ জন্য নিজেদের মতো নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। গাইবান্ধার নির্বাচন বন্ধ করা নির্বাচন কমিশনের কৌশল বলে মনে করেন তিনি।

ডিসি এসপিরাই ইসির কথা শোনে না : বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিজেদের ভালো দেখানোর জন্য সবরকম কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। গাইবান্ধায় ভালো নির্বাচন করেছে। কিন্তু ডিসি এসপিরাই তাদের কথা শুনে না। তারা কী নির্বাচন করবে? তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

জনস্রোত ঠেকানো যায়নি : সমাবেশ বানচাল করতে সরকার বাধা দিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, খুলনাবাসী অসাধ্য সাধন করেছে। জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে সব জায়গায় বাধা দিয়েছে। বাস, লঞ্চ, নৌকা-সব বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও জনস্রোত ঠেকানো যায়নি। সমাবেশেকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার, সহস্রাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে।

লুটপাটের কারণে দুর্ভিক্ষ : মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। অথচ সরকারই বলেছিল দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ ধরনের মিথ্যা প্রচার করে তারা জনগণের সাথে প্রতারণা করে এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছে। ’৭৪ সালেও আওয়ামী লীগের আমলে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বইতে লিখেছেন, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও লুটপাটের কারণে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, সমাবেশ সফল করতে কোথায় সহযোগিতা করা হয়েছে? উল্টো নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, কুপিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছেন। কোথাও সহিংসতা করছেন না, বরং আওয়ামী লীগ সহিংসতা করছে। তারা সন্ত্রাসের দল, দেশকে নরকে পরিণত করেছে।

পদত্যাগ না করলে পালানোর পথ খুঁজে পাবে না : মির্জা ফখরুল বলেন, এখন পদত্যাগ না করলে পালানোর পথ খুঁজে পাবে না সরকার। এখনো সময় আছে নিরাপদে চলে যান। নইলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে ক্ষমতায় গেলে কী করবেন তার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বিচারবিভাগীয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিদ্যুতের দুর্নীতির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন করা হবে।

একজন আন্ডার সেক্রেটারির দেখাও পাননি : বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অবৈধ ভোট ডাকাত সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে র‌্যাব পুলিশ ব্যবহার করছে। এসব অনেক করেছেন। সব খেলা শেষ। চেয়ে দেখুন কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তিনি একজন আন্ডার সেক্রেটারির দেখাও পাননি। দেশের নানাবিধ সঙ্কট তুলে ধরে তিনি বলেন, কিছুই যদি না পারেন তাহলে আপসে সরে দাঁড়ান, অন্যথায় রাজপথেই ফয়সালা হবে।

সারা জীবন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে : বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় বলেন, শেখ হাসিনার চাচীর ছেলেরা বলেছিল পদ্মার এ পাড়ে দাঁড়াতে দেয়া হবে না। আমি বলব আপনাদের কিছুদিন পরই সারা জীবন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্রাকটিস শুরু করে দিন। তিনি বলেন, আমরা এ কথা কখনোই বলব না যে গোপালগঞ্জের মানুষদের ঢাকা যেতে দেয়া হবে না। কারণ আমরা ভদ্রতা বজায় রেখে রাজনীতি করি।

গয়েশ্বর রায় বলেন, পুলিশ শেখ হাসিনার বাড়ির চাকর-বাকর নয়। কোনো অন্যায় আদেশ আপনারা মানবেন না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার মুক্তি দিতে হবে না। শেখ হাসিনা বিদায় হলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন এবং তারেক রহমানও দেশে ফিরে আসবেন।

সরকার জনগণকে ভয় পায় : বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, এ সমাবেশ প্রমাণ করেছে সরকার জনগণকে ভয় পায়। এই আওয়ামী লীগ সরকার যে ব্যর্থ সেটি আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে। আজকের সমাবেশ পরিণত হয়েছে লাখো মানুষের মহাসমাবেশে। এই অবৈধ সরকার সমাবেশ বানচাল করতে দুই দিন হরতাল ডেকেছে। কিন্তু এসব করে কোনো লাভ হয়নি। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই, তা না হলে দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি না। জনগণের ভোটাধিকার ও মৌলিক দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি।

সরকার আর বেশি দিন নেই : শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সব কিছু বন্ধ করে, হামলা চালিয়ে সমাবেশ ঠেকাতে পারেননি। আমি বলছি, এই সরকার আর বেশি দিন নেই। এ বছর টিকে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। তিনি বলেন, হুঁশ থাকতে সরে যান। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন।

সংগ্রাম শুরু হয়েছে : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দুর্নীতিবাজ, ডাকাতদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকার স্বাধীনতার কথা বলে অথচ তারা যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়েছিল আর অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। সমাবেশ শেষে মাইকে নেতা-কর্মীদের সতর্ক থেকে গন্তব্যে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। হামলা হতে পারে এমন বার্তাও দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *