বর্তমানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণলায়ের দায়িত্ব পালন করছেন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ২০১৮ সালে প্রথমবার জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য হন তিনি। সিলেট-১ আসন থেকে বিজয়ী হন মোমেন। আর প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়ে পেয়ে যান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণলায়। এর আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার খোরাক হচ্ছেন মোমেন। আবার সেই দায়টা উলটো গণমাধ্যমের কাঁধে দিচ্ছেন। এই প্রতিবেদনে গত চার বছরে তার বিতর্কিত বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি বৈশ্বিকভাবে খাদ্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে ১২ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণবিষয়ক এক মতবিনিময়সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি।’ এমন মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগা মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে (মোমেন) বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) চট্টগ্রামে এক আলোচনাসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। সেজন্য শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।’
ঠিক একদিন পর শুক্রবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারের লক্ষ্য যে আমরা সস্তায় অ্যাফোরডেবল প্রাইসে প্রত্যেককে খাবার দিতে চাই। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করতে চাই। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা আমরা দেখতে চাই না, অস্থিরতা দেখতে চাই না।’ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাদের মিডিয়া অনেক সময় এই অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য অনেক বানোয়াট খবর-টবর দেয়। এটা খুব দুঃখজনক।’
এদিকে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সহায়তা চেয়েছেন সর্বশেষ তার এমন বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। একটা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার বার এমন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছেন না তার নিজ দলের সাধারণ সম্পাদক। শুক্রবার (১৯ আগস্ট) রাজধানীর পলাশীর মোড়ে কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমী মিছিল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, করেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে এমন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। যিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এ কথা বলেছেন, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। সেটা আমাদের সরকারের বক্তব্য না, দলেরও না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কীভাবে এ কথা বলি? এতে করে ভারতও লজ্জা পায়।’
শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ জানানোর বিষয়ে যে বক্তব্য মন্ত্রী দিয়েছেন তার কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এছাড়া তার অসংবেদনশীল বক্তব্যে বিব্রত দল।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে কেবল সরকার বা আওয়ামী লীগই বিব্রত না, বাংলাদেশের কোটি কোটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ আজ বিব্রত। তিনি তার বক্তব্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। আমি মনে করি তার বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে, কথা বলার ক্ষেত্রে সরকারের একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে তারা আমাদের ক্ষমতায় রাখবে বা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করবে এমনটি ভাবা বা চিন্তা না করাই ভালো। যদি কেউ এ ধরনের কথা বলে থাকে, তাহলে আমি মনে করি সে দায়িত্বশীল কথা বলেনি।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেন মোমেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনী থেকে জন্ম নেয়া দলটি ছাড়া সব দল নির্বাচনে আসে। তাদের নির্বাচনে আনা একটি চ্যালেঞ্জ। তাদের ভোটে নিয়ে আসুন।’
মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার পর প্রথমেই ভারত সফরে যান মোমেন। ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে গিয়ে বলেন, উভয় দেশের সম্পর্ক খুবই ভালো। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। এটি নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়।
সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন হঠাৎ করেই মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে সরাসরি রাজনীতির মাঠে। ভাইয়ের (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী) হাত ধরে সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ আসন থেকে মনোনয়ন পান তিনি। ২০১৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হন। প্রথমবার এমপি হয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচিত-সমালোচিত মোমেন।
সাবেক কূটনীতিকরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ‘মন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য এবং দলের জন্য মর্যাদাহানিকর। তাই মন্ত্রীর বক্তব্য খতিয়ে দেখার পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তার এ বক্তব্যকে পুঁজি করে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে।