ডলার মূল্যের উর্ধ্বমুখীর পাগলা ঘোড়া কোনোক্রমেই বাগে আনা যাচ্ছে না। গতকাল সব রেকর্ড অতিক্রম করে খোলা বাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১১৯ টাকা থেকে ১২০ টাকা দরে। এ দর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্তঃব্যাংক দরের চেয়ে প্রায় ২৫ টাকা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৫ টাকা। মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি জোরদার, বেশ কিছু মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত, বড় ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি হেডদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কোনো কিছুতেই যেন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে। বরং দিনে দিনে টাকার বিপরীতে ডলারের উলম্ফন বেড়ে যাচ্ছে। গতকালও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪০ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে ১৬০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
ডলারের মূল্য এ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি জোরদার। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করছি। একই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজার তদারকি অব্যাহত রাখা হবে। তিনি বলেন, গতকালও আমরা বাজারে ১১৪ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে।
মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সমস্যা হলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনই ডলারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে থেকে এনে নগদ ডলার কেনাবেচা করি। যারা বিদেশ যান তাদের খুচরা কিছু ডলার লাগে। ব্যাংকে গেলে বিভিন্ন ঝামেলা হয়। আমাদের কাছ থেকে সহজে ডলার কিনতে পারে। খুচরা ৫০, ১০০ থেকে ১০০০ ডলার কেনাবেচা করি। যারা বিদেশ থেকে খুচরা ডলার নিয়ে আসেন তারা আমাদের কাছে বিক্রি করেন। আবার অনেকে ডলার নিয়ে বিদেশে যান, সব খরচ হয় না, তারাও ফেরত দেন। প্রতিদিন দুই তিন হাজার ডলার বিক্রি হয়। বাজার ভালো থাকলে এক দেড় হাজার টাকা পাই। এখন বাজারে ডলারের চাহিদা আছে। কিন্তু ডলার নেই। দামেরও ঠিক নেই। আবার ভয় আছে। আগে সরাসরি বিক্রি করলে কোনো সমস্যা হতো না। এখন পুলিশে ধরছে। তাই ব্যবসা করা সমস্যা। একজন ব্যবসায়ী জানান, সকালে শুরুতে নগদ ডলার বিক্রি করেছি ১১৬ টাকায়। পরে আর ডলার নেই। দুপুরে তা ১১৯ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করেছি।
জানা গেছে, দেশে খোলা বাজারে ডলার প্রথমবারের মতো গত ১৭ মে ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায়। এরপর আবার কমে আসে। পরে গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। এর পর থেকে খোলা বাজারে আর ডলারের মূল্য কমেনি, বরং দিন দিন বেড়ে গেছে। গত ৮ আগস্ট প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকায়। ৯ আগস্ট বন্ধ ছিল। কিন্তু গতকাল তা প্রতি ডলারে ৫ টাকা বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১২০ টাকা।
শুধু খোলা বাজারে নয়, ব্যাংকেও নগদ ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে ১১৩ টাকা দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে। চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৫ কোটি ডলার। কিন্তু আতঙ্কের বিষয় হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বেশি দরে ডলার এনে বাজারে ডলার সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ডলার সংগ্রহ করা হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে। বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছে কম দরে রেমিট্যান্স আহরণ করতে চাইলে রেমিট্যান্স আহরণ কমে যেতে পারে। বাড়তে পারে হুন্ডি তৎপরতা।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। গত ১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ৪০ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ১৬০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। শুধু গতকালই বিক্রি করা হয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ৮ আগস্ট ছিল ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমদানি চাহিদা কমানোর জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা কিছুটা সফল হয়েছে। প্রথমে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলারের বেশি এলসি খুলতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। পরে তা আরো কমিয়ে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ ডলার করা হয়।
এর ফলে এলসি খোলার হার কমে এসেছে। তবে বিগত দিনের এলসির দায় বকেয়া রয়েছে। একই সাথে চলতি এলসির দায়ও পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে এলসি কমে যাওয়ার সুফল পেতে আরো কমপক্ষে দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।
তবে, সাধারণ গ্রাহকের প্রশ্ন, ডলার দামের এ উল্লম্ফন কত দূর যাবে। ব্যবসায়ীদের মতে, তৈরি পোশাকের বিদেশী ক্রেতারা আগের মতো ক্রয়াদেশ দিচ্ছে না। অর্থাৎ অর্ডার কমে আসছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে অর্ডার কমে যাচ্ছে, বিপরীতে বিদেশী ক্রেতারা দাম বাড়াচ্ছে না, অপর দিকে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়, সব মিলেই সামনে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকবে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে, আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে চাপ প্রয়োগ করে আমদানি কমানো হলেও নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ কমে যাবে। তখন বাজারে সঙ্কট তৈরি হবে। বাধ্য হয়ে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি বাড়াতে হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমবে না, বরং বেড়ে যেতে পারে। এ পরিস্থিতি সরবরাহ না বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য কোথায় যাবে তা নিয়ে সন্দিহান করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেমিট্যান্স আনার পথ সহজ করা হলো : এদিকে রেমিট্যান্স আনার পথ সহজ করে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে বিদেশস্থ এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার চুক্তি করতে (ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল এক নির্দেশনায় এটা শিথিল করেছে। অর্থাৎ এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্থাপনের পর ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় তথ্যসহ বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে।
একই সাথে ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট স্থাপনে বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস/ হাইকমিশনের প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজনীয়তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স থাকা সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট এক্সচেঞ্জ হাউজের বিষয়ে অতিরিক্ত ডিউডিলিজেন্স সম্পাদন করে ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।