দাঁত ও মাড়ির যত্নে করণীয়

লাইফস্টাইল


ডা: হুমায়ুন কবীর হিমু : দাঁত ও মুখের যত্নে সকালে নাস্তার পর এবং রাতে ঘুমানোর আগে একটি ভালো টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। ভালো টুথপেস্টের উপাদান সম্পর্কে সাধারণ জনগণের জানা খুবই জরুরি। ফ্লোরাইডযুক্ত একটি টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে টুথপেস্টে ফ্লোরাইডের মাত্রা যেন ১০০০-১২০০ পি.পি.এম এর মধ্যে হয়। ফ্লোরাইরেডের পরিমাণ বেশি হলে দাঁতে ফ্লোরোসিস হয়ে থাকে। এতে করে দাঁত ভঙ্গুর প্রকৃতির হতে পারে। দাঁতে রঙের পরিবর্তন আসতে পারে।

প্রতিটি টুথপেস্টের দাঁত পরিষ্কার করার একটি ক্ষমতা থাকে। টুথপেস্টের আর.ডি.এ যে ৩০-৮০ এর মধ্যে থাকে। আর.ডি.এ বলতে বুঝায় রিলেটিভ ডেন্টিন এব্রেশন। এর মাত্রা ৩০ এর নিচে হলে দাঁত পরিষ্কার কম হবে। তবে টুথপেস্টের আর.ডি.এ এর মাত্রা ১৫০ এর বেশি হলে দাঁতের এনামেল এবং ডেন্টিন ক্ষয় হয়ে যাবে। তাই এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। টুথপেস্টে এন্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান ট্রাইক্লোসান রয়েছে। সেনসোডাইন টুথপেস্টে ট্রাইক্লোসান থাকে না। ট্রাইক্লোসান জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে টুথপেস্টে ট্রাইক্লোসানের পরিমাণ যেন বেশি না হয়। বেশি হলে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাহত হতে পারে- বিশেষ করে মুখে।

টুথপেস্টে ট্রাইক্লোসান থাকলেও এফডিএ এন্টিব্যাকটেরিয়াল সাবানে ট্রাইক্লোসান সংযোজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ত্বকে সরাসরি সংযোগের কারণে ত্বকের প্রদাহ, কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। যাই হোক আমরা টুথপেস্ট এর আলোচনায় ফিরে যাই। ট্রাইক্লোসান মাড়ির প্রদাহ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে থাকে। যাদের মাড়ি রোগ আছে তারা ট্রাইক্লোসান সমৃদ্ধ টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুথপেস্ট কলগেট টোটাল একটি আদর্শ ট্রাইক্লোসান সমৃদ্ধ টুথপেস্ট।

টুথপেস্টের আরেকটি উপাদান এসএলএস বা সোডিয়াম লরিল সালফেট। সোডিয়াম লরিল সালফেট এর কারণে টুথপেস্টের ফেনা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এসএলএস যুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করলে অথবা এসএলএস এর পরিমাণ বেশি হলে মুখে আলসার বা ঘাঁ দেখা দেয়। তাই মুখের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে।

দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য আমরা মাঝে মাঝে মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করে থাকি। থ্যারাপিউটিক এবং কসমেটিক উভয় ধরনের মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এলকোহল যুক্ত মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা ঠিক নয়। দাঁত ব্রাশ করার পরপর মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা যাবে না। দাঁত ব্রাশ করার কমপক্ষে ৩০ মিনিট পর মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। কারণ টুথপেস্টে যে ট্রাইক্লোসান থাকে তা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বাধা দেয় দাঁতে কোনো কিছু লেগে থাকার জন্য। কিন্তু অনেককে দেখা যায় দাঁত ব্রাশ করার পর পর মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করে থাকেন। এতে মাউথ ওয়াশের কার্যকারিতা কমে যায়। অসুস্থ অবস্থায় একজন মানুষ যখন টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে পারে না, তখন মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা যায়। কৃত্রিম দাঁত পরিষ্কার করার সময় টুথব্রাশ দিয়ে স্বাভাবিক দাঁতের মত পরিষ্কার করতে হবে। কৃত্রিম দাঁত পরিষ্কার না করলে দাঁতে এবং মুখে বিভিন্ন রোগ এবং ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মাঝে মাঝে দেখা যায় কৃত্রিম দাঁত পাশের দুই দাঁতের সাথে ফিক্সড করে লাগিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত হাতুড়ে ডাক্তাররা ক্ষতিকর ক্যামিকেল দিয়ে এসব লাগিয়ে থাকেন। এতে করে পাশের দুই দাঁত নষ্ট হওয়াসহ রোগীর মুখে ক্যান্সার হতে পারে। এসব বিষয়ে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

দাঁতের যতেœ দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থানে পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ দুই দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা জমে থাকলে দাঁতে ক্যারিজ দেখা দেবে। দুই দাঁতের ফাঁকে পরিষ্কার করার জন্য ইন্টারডেন্টাল ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে। ইন্টারডেন্টাল ব্রাশ ব্যবহার করলে দুই দাঁতের মাঝখানে খাবার জমে থাকবে না। দাঁতের যত্নে দাঁত ব্রাশ করার আগে ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করতে হবে। এটি দাঁত পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ ধরনের সূতা। ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করার মাধ্যমেও দুই দাঁতের মধ্যবর্তী খাদ্যকণা সহজেই পরিষ্কার করা যায়। তবে ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করার সময় খেয়াল রাখতে হবে ফ্লস যেন মাড়িতে আঘাত না করে। মনে রাখতে হবে ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করা হয় দাঁতের জন্য। মাড়ির জন্য নয়।

ভালোভাবে ডেন্টাল ফ্লস করার পর ভালো একটি টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা করার সময় দাঁতের উপরিভাগে ব্রেস পড়ানো হয়ে থাকে। ব্রেস পড়ানোর কারণে অধিক পরিমাণে খাদ্যকণা দাঁতে জমে থাকতে পারে। এসব পরিষ্কার করার জন্য আঁকাবাঁকা চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ডিজাইনের এবং বিভিন্ন আকৃতির ছোট ছোট ব্রাশ পাওয়া যায়। এসব ব্রাশ দিয়ে চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে অনেকগুলো দাঁতে ক্যারিজ হতে পারে। দাঁতের ব্রিজ বা ইমপ্ল্যান্ট করা হলে পাশের দাঁতগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। ব্রিজের ক্ষেত্রে পাশের দাঁতগুলো না রাখলে পেরিওডন্টাল রোগ হয়ে ব্রিজ অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে। ইমপ্ল্যান্ট এর ক্ষেত্রে একইভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিষ্কার না রাখলে চারপাশের টিস্যুগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে ইমপ্ল্যান্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সম্ভাবনা কম হলেও অসম্ভব কিছু নয়।

দাঁতের যত্নে শুধু মাত্র ব্রাশ করলেই হবে না বরং জনগণকে বোঝাতে হবে দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থানে ব্রাশ করার মাধ্যমে পরিষ্কার রাখার জন্য। একজন রোগী আসলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই দাঁতের মাঝখানে ক্যারিজ নিয়ে এসেছে। শুধু মাত্র দুই দাঁতের মাঝখানে সঠিকভাবে পরিষ্কার করলে দন্তক্ষয়ের পরিমাণ অনেক কমে আসবে। মাউথ ওয়াশ যে সব সময় ব্যবহার করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে মাড়ি রোগে অথবা দাঁতের স্কেলিং করার পর ক্লোরোহেক্সিডিন মাউথ ওয়াশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

নবজাতকের দাঁতের যত্নে তুলা অথবা গজ দিয়ে মাড়ি পরিষ্কার করে দিতে হবে। অন্যথায় ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দেবে। শিশু মায়ের দুধ খাওয়ার পর দাঁত পরিষ্কার করে দিতে হবে অথবা দুধের বোতলে কিছুটা পানি পান করালে দাঁত পরিষ্কার হয়ে যাবে। অন্যথায় নার্সিং বোতল ক্যারিজ দেখা দেবে। এতে করে অনেকগুলো দাঁতে একসাথে ক্যারিজ দেখা দিতে পারে। শিশু একটু বড় হলে বেবি টুথব্রাশ ব্যবহার করা উচিত।

বড়দের ক্ষেত্রে পরিবারের সবার টুথব্রাশ একসাথে রাখা উচিত নয়। কারণ এতে করে ছত্রাক সংক্রমণসহ করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। টুথব্রাশ হোল্ডার নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। কারণ টুথব্রাশ হোল্ডারে লক্ষ লক্ষ জীবাণু বসবাস করে। পরিবারের সবার টুথব্রাশগুলো আলাদা আলাদা ভাবে রাখা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *