বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল দিতে পারছে না পিডিবি

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি অনুযায়ী বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই পিডিবি তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। আইপিপি, রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল এবং আমদানি করা বিল পরিশোধ করতে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল (পিএসডিএফ) থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে পিডিবি। তবে পিডিবিকে ঋণ দিতে অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বিল পরিশোধে দফায় দফায় বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থ ছাড় বা ভর্তুকি পরিশোধ করতে তাগাদা দিলেও কার্যত অর্থ মিলছে না। এদিকে পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে লেখা চিঠি থেকে প্রমাণ হয় প্রচ- আর্থিক সংকটে পড়েছে পিডিবি। প্রত্যাশিত অর্থ না পাওয়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরাও ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। একদিকে সরকারি গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি; অন্যদিকে তেল সংকটে ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হয়েছে। সরকারও প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় লোডশেডিংয়ে সমাধান খুঁজছে। নানামুখী পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। আপাতত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সাশ্রয়ের চেষ্টাও করছে। আলোচনা চলছে পরিবহন খাতে তেলের ব্যবহার কমিয়ে আরও জ্বালানি তেল সাশ্রয় করার।

পিডিবি সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিল পরিশোধ করতে প্রতি মাসেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি বাবদ অর্থ পেয়ে থাকে। তবে গত কয়েক মাস আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে পিডিবি চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি পাচ্ছে না। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ চায়। তবে বিইআরসি তাতে সম্মতি দেয়নি।

সূত্রে জানা যায়, পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বরাবর লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বর্ধিত বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সরকারি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনে সেটা বিতরণ কোম্পানিকে সরবরাহ করে থাকে। তবে বরাবরই সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম দামে বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিশাল আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়েছে।

এদিকে সরকার ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন মূল্য অপেক্ষা কম দামে বিক্রির ফলে যে ঘাটতি হয় তা ভর্তুকির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। বিশেষ করে ডিজেল ও ফার্নেসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি উৎপাদন করতে হয়। যার কারণে বেসরকারি মালিকদের কাছে পিডিবির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের টাকাও অনেক বেশি হয়ে পড়েছে। সরকারের কাছ থেকে রাজস্ব বাজেটের আওতায় যে ভর্তুকির অর্থ পাওয়ার কথা, নানা কারণে তা পেতে দেরি হচ্ছে।

পিডিবি বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুুয়ারির বিলের আংশিক জুলাই মাসে এসে পরিশোধ করা হয়েছে। অপরিশোধিত রয়ে গেছে প্রায় ২ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসের বিল বাবদ আরও জমে গেছে ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তার সঙ্গে ফেব্রুয়ারির অপরিশোধিত বিল যোগ করলে হয় ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এসব বিলের মধ্যে মার্চ মাসের বিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, এপ্রিলে ৬ হাজার ৬০০ কোটি, মের ৬ হাজার ৩০০ কোটি এবং জুন মাসের ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। তবে মে এবং জুন মাসের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ পিডিবি রাজস্ব পেয়েছে সাত হাজার ৮৬ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী সংস্থাটির ২ ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

পিডিবি বলছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের ঠিক সময়ে বিল পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা জ¦ালানি তেল আমদানি করছে না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেশি হওয়ায় তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। অন্যদিকে গ্যাসস্বল্পতার কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে।

পিডিবি তাদের চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছে- ২০২১-২২ অর্থবছরে আইপিপি, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় ঘাটতি বাবদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ২০২১ সালের জুলাই থেকে একই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট সাত হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি বাবদ পেয়েছে পিডিবি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সামগ্রিক অবস্থায় প্রচ- আর্থিক সংকটে আছে সংস্থাটি। ফলে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে পিডিবি ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরির আবেদন করছে। তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) পিডিবির আবেদনকে গুরুত্ব দেয়নি। তাদের আবেদনে কোনো সম্মতি দেয়নি। বিইআরসি পিডিবির আবেদনকে গুরুত্ব না দেওয়ায় সংস্থাটি বিদ্যুৎ সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে, যাতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরি পেতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

এ বিষয়ে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল এবং বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল মূলত গঠন করা হয়েছে গ্রাহকদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে। এই টাকা ব্যবহারেরও সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এই তহবিল জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু সরকার এই টাকা অনেকটা লুণ্ঠনমূলক ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল জ্বালানি বিভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যবহার করছে, যা করার কথা ছিল না। এদিকে পিডিবি রেন্টাল, কুইক রেন্টালের বিল পরিশোধ করতে এই টাকা চাইতে পারে না। এটা অনিয়ম। এই টাকা বিইআরসি ব্যবহার করবে গ্রাহকদের কল্যাণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *