যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের সমস্যায় পড়া ছয়টি গ্যাসকূপের মধ্যে তিনটি মেরামত করা হলেও বাকি তিনটি মেরামতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ কারণে রাজধানীতে চলমান গ্যাস সঙ্কট কাটতে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে- এমন আভাস পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সক্ষমতার চেয়ে বাড়তি উৎপাদন করতে গিয়েই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। এতে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে প্রায় সাড়ে চার শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে, যা গ্যাস ক্ষেত্রটির চলমান উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ। এ কারণেই বেড়ে গেছে সঙ্কট।
এদিকে, রমজানের শুরুতেই গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করায় দুর্ভোগে পড়েছে রাজধানীবাসী। সেহরি, ইফতার, স্কুল খোলা থাকায় স্কুলগামী শিশুদের নাস্তা তৈরি থেকে শুরু করে গৃহস্থালী কাজকর্ম সর্বত্রই অচল অবস্থা দেখা দিয়েছে। সামর্থ্যবানরা বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার কিনছেন। এ কারণে সিলিন্ডারের দোকানগুলোতে ভিড় পড়ে গেছে। অপরদিকে, যারা সামর্থ্যবান নন, তারা বিকল্প হিসেবে হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। কেউবা সিলিন্ডার ব্যবহার করেন এমন আত্মীয়স্বজনের বাসা থেকে খাবার রান্না করে প্রয়োজন মিটাচ্ছেন।
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং গ্যাস উৎপাদন কাজে অভিজ্ঞদের মতে, গ্যাস সম্বলিত ভূ-স্তর আবিষ্কার করার পর ডিএসটি’র (ড্রিল স্পেম টেস্ট) মাধ্যমে ভূ-স্তরে গ্যাসের পরিমাণ, সর্বোচ্চ গ্যাস উৎপাদনের হার, গ্যাসের চাপ, তাপ ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়। ডিএসটির মাধ্যমে যে সর্বোচ্চ গ্যাস উৎপাদনের হার নির্ণয় করা হয়, সেই উৎপাদন হারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করা ওই ভূ-স্তরের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। কোনো কারণবশত এ হারের অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করা হলে ভূ-স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্যাসের সাথে বালি, পানি আসা শুরু হয়। এ কারণেই গ্যাসের সাথে বালি আসা শুরু হওয়ার সাথে সাথে হয় গ্যাস উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে বালির প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয় অথবা বালি আসা বন্ধ না হলে ক্রমান্বয়ে গ্যাস উৎপাদন কমাতে কমাতে একপর্যায়ে উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হয়। এমনটি ঘটেছিল সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্রে।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে তিনটি বিদেশি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরন তিনটি গ্যাসক্ষেত্র যেমন, জালালাবাদ, মৌলভীবাজার, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি তাল্লো বাংগোরা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করত। ওই অর্থবছরে দেশের উৎপাদিত গ্যাসের ৫২ শতাংশ উৎপাদন করে এ তিনটি বিদেশী কোম্পানি। কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর থেকে দুটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ উত্তোলন করছে শেভরন।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ৩১ মার্চ বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদনের ক্ষমতা দেখানো হয়েছে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু ওই দিন উৎপাদন করা হয়েছে ১২৫ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট গ্যাস। ১ এপ্রিল একই ক্ষেত্র থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন করা হয় ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। পরপর দুই দিন উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বাড়তি উৎপাদন করতে গিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। পরের দিনই ২ মার্চ গ্যাস উৎপাদন কমে ১১৫ কোটি ঘনফুটে নেমে যায়। ৩ মার্চ একই ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে হয় ৮৮ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বাড়তি উৎপাদন করতে গিয়ে ছয়টি কূপ থেকে গ্যাসের সাথে বালি আসতে থাকে। শেভরনের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ছয়টি কূপের মধ্যে তিনটি মেরামত করা সম্পন্ন হলেও আগের হারে আর উৎপাদন সম্ভব হবে না। গতকাল সোমবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৯টা) মেরামত করা তিনটি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তবে শেভরন সূত্র জানিয়েছে, রাতের মধ্যেই অর্থাৎ আজ মঙ্গলবার থেকে ওই তিনটি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন করা যাবে। কিন্তু বাকি তিনটি কূপের মেরামত এখনো সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ এটি মেরামত হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে শেভরনের কর্মকর্তা মো: জাহিদ হাসান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তিনটি মেরামত হয়েছে যা রাত থেকেই উৎপাদনে আসবে। বাকি তিনটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে, শিগগিরই কাজ সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিবিয়ানা অন্যতম। এ ক্ষেত্রের ছয়টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জোগানের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকায়। সঙ্কট কাটিয়ে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জানিয়েছে, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে কিছু কিছু গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘœ ঘটছে। ফলে কোনো কোনো এলাকায় সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
এদিকে গ্যাস সঙ্কটের কারণে রাজধানীর আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, কাফরুল, আদাবর, বনশ্রী, খিলগাঁও, রামপুরা, আজিমপুর, লালবাগ, ধামমণ্ডি, সিদ্ধেশ্বরী, কাঁঠালবাগান, মিরপুর, ক্রিসেন্ট রোড, জিগাতলা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, এলিফ্যান্ট রোড, গ্রিন রোড, মতিঝিল, সেগুনবাগিচা, নারিন্দা, মিরপুর ১, ২ ও ১০ নম্বর এলাকায় গতকাল গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেয়। এতে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। একদিকে রমজান শুরু হয়েছে, সেই সাথে খোলা রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেহরি, ইফতারি, স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা।
রামপুরার বাসিন্দা আয়শা আক্তার নামের এক গৃহিণী বলেন, মাস গেলেই নিয়মিত গ্যাসের বিল দিতে হয়। কিন্তু প্রায়ই গ্যাসের চাপ থাকে না। এর মধ্যে প্রথম রমজান থেকে শুরু করে গতকাল দ্বিতীয় রমজান পর্যন্ত রান্না করতে তিনি সঙ্কটে পড়ে গেছেন। দুই দিনই বাসায় ইফতারি বানাতে পারিনি। সব বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে। রমজান মাসে গ্যাসের সঙ্কটে যে আমাদের কত বড় সমস্যা হয় এ কথা বোঝানো যাবে না। বলতে গেলে গ্যাসের কোনো চাপই নেই। এদিকে অনেকেই গ্যাস সিলিন্ডার কিনছেন। কেউবা বিকল্প হিসেবে হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাসা থেকে গ্যাস সিল্ডিন্ডারে রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এ ভোগান্তি কবে শেষ হবে তাও জানে না রাজধানীবাসী।