গাজীপুরঃ গাজীপুর জেলার সবচেয়ে প্রাচীন দরগামেলা তিনদিন পর সমাপ্ত হয়েছে। একদিনের এই গ্রামীন মেলা চলে যায় তিন দিন। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডর হয়দেবপুর ও জাহাঙ্গীর পুর গ্রামের সীমান্ত রেখায় এই মেলার অবস্থান।
স্থানীয়দের প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, পীরে কামেল হযরত মাওলানা শাহ সুফি মোঃ ইলিসার শাহ কেবলা (র:) ভাওয়াল পরণায় আসার পর এই জায়গায় অবস্থান করতেন। তিনি এখানে খোলা মাঠে ইমামতি করতেন। প্রবাদ রয়েছে, পীর সাহেব ইমামতি করার আগে আযান দিতেন। আযানের সাথে সাথে হঠাৎ করেই এলাকার কয়েকজন মুসল্লীর পাশাপাশি কাফনের কাপড়ের মত সাদা পোষাকের অসংখ্য মুসুল্লী নামাজ আদায় করতেন। সালাম ফেরানোর পর মোনাজাতে অংশ নিতেন ইমাম সহ সকল মুসল্লী। কিন্তু মোনাজাত শেষে নামাজে অংশ নেয়া স্থানীয় মুসুল্লীদের ছাড়া আর কাউকে দেখা যেত না। আগাত মুসুল্লী ও ইমাম সাহেব নিরাকার হয়ে যেতেন। প্রবাদ থেকে আরো জানা যায়, হুজুর এই জায়গায় আসার সাথে সাথে অরণ্য জঙ্গলের অসংখ্য প্রাণী আপন মনে একাধিক আনন্দ চিৎকার করে হুজুরের আগমন জানান দিতেন। এই জানানোর মাধ্যমে এলাকার মুসুল্লীরা এই জায়গায় সমবেত হতেন ও নামাজ আদায় করতেন। হযরত ইলিয়াস শাহর এই ঐতিহাসিক আগমনী স্থানকে পরবর্তি সময় হুজুরের দরবার বলে আখ্যায়ায়িত করা হয়। এই জায়গার নাম হয় হয়দেবপুর দরগাহ।
হযরত ইলিয়াস শাহর মৃত্যুর পর তার লাশ দাফন করা হয় হয় রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভী বাজার এলায় অবস্থিত গুলবদন শরীফে। বর্তমানে ১৬বিঘা জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত গুলবদন শরীরেই হযরত ইলিয়াস শাহর কবর অবস্থিত। প্রতি বছর গুলবদন শরীফে ঔরশ অনুষ্ঠিত হয়। আর ভাওয়াল পরণার হয়দেবপুর দরগায় অনুষ্ঠিত হয় ঔরশ ও মেলা। প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম বৃহসপতিবার ঔরম ও মেলার দিন ধার্য় থাকায় সারাদেশ থেকে মানুষ কোন আমন্ত্রন ছাড়াই মেলায় উপস্থিত হয়ে যায়। বিশ্ব মহামারী করোনার সময়েও এই মেলা ও ঔরষ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এই কড়া সময়েও মেলা ও ঔরশে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ৫০ হাজারে বেশী মানুষও জমায়েত হয়েছে।
বর্তমানে এই ঔরশ ও মেলায় আগন্তকদের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। বৃহসপতিবার মূল পর্ব থাকলেও মঙ্গলবার থেকে লোকজন ও দোকানপাট আসা শুরু হয়ে শুক্রবার ফিরে যায়। ফলে একদিনের অনুষ্ঠান তিনদিন স্থায়ী হতে বাধ্য হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যে দরগায় মিলাদ মাহফিল, বাউল গান, কয়েক দফায় তবারক বিতরণ রয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় স্কুলে থাকে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান সহ নানা ধরণের আয়োজন।
১৯৬৫ সালে হয়দেবপুর গ্রামে অবস্থিত এই দরগায় ছোট পরিসরে ঔরশ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তি সময় স্থানীয়ভাবে বড় করে ঔরশ শুরু করেন সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৯ সনে অবসরে আসা সুবাদার মেজর এম এ সামাদ সাহেব। সামাদ সাহেব দরগার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত করেন হয়দেবপুর দরগা বাজার, হয়দেবপুর দরগা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হয়দেবপুর দরগা বাজার পোষ্ট অফিস,হয়দেবপুর সোলেমানিয়া এবতেদায়ী মাদ্রাসা, হয়দেবপুর দরগাহ কাজী অফিস, ঈদগাহ মাঠ এবং সুবাদার মেজর এম এ সামাদ সাহেবের আবেদনের ভিত্তিতে তার মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠিত হয় হয়দেবপুর দরগা কমিউনিটি ক্লিনিক ও মসজিদ সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় কাওরাইদ ইউনিয়নে সুবাদার মেজর এম এ সামাদ সাহেব সর্বোচ্চ জমি দাতা ও একাধিক সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিাতা।
মরহুম সামাদ সাহেবের স্ত্রী, তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে এডভোকেট এ কে এম আব্দুল হাই স্বপন গাজীপুর আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী। মেঝো ছেলে ড. এ কে এম রিপন আনসারী গাজীপুর জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ছোট ছেলে ড. এ কে এম লুৎফর রহমান রতন ২৭তম বিসিএস(শিক্ষা) ক্যাডারে বাংলাদেশে প্রথম হয়ে বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে কর্মরত।
বাবার সাথে শিশুকাল থেকেই এই মেলার দায়িত্ব পালন শুরু করেন মরহুমের মেঝো ছেলে রিপন আনসারী। বাবার মৃৃত্যুর পর থেকে বড় ভাই এডভোকেট আব্দুল হাই স্বপনের তত্ত্বাবধানে ও ছোট ভাই লুৎফর রহমান রতনের ব্যবস্থাপনায় মেঝো ভাই রিপন আনসারী নেতৃত্বে চলছে গাজীপুর জেলার এই প্রাচীন অনুষ্ঠান। আইন শঙ্খলা বাহিনী ছাড়াই কোন রকমের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি লাখো মানুষের এই উৎসবে। অতি প্রাচীণ এই উৎসব স্থানীয়ভাবে কয়েকটি গ্রামে ঈদ উৎসবের আমেজ তৈরী করেছে। ১৯৯৬ ও ২০০৪ সালে মেলার আমন্ত্রন না পেয়ে দুটি বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনাও ঘটেছে। মেলা এলাকায় শশুর বাড়ি হওয়ায় মেলার দাওযাত না পেয়ে উত্তেজিত স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেন। পরবর্তি সময় মেলার পক্ষ থেকে রিপন আনসারীর হস্তক্ষেপে সেই দুটি বিবাহ পুনরায় সম্পন্ন করা হয়।
এবার ১৫ মার্চ মঙ্গলবার থেকে মেলায় সারাদেশ থেকে দোকানপাট আসা শুরু হয়। ১৮ মার্চ শুক্রবার মেলার সমাপ্তী ঘটে। একদিনে অনুষ্ঠানের লাখো মানুষের সমাগম শেষ হয় চার দিনে। স্থানীয়রা বলছেন, বেশ দিন ধরে দিনে বেশ কয়েকবার বিদ্যৃুৎ এর লোড শেডিং থাকলেও এই মেলায় চার দিনে এক সেকেন্ডর জন্যও শেডিং হয়নি। মেলা শেষে আবার লোড শেডিং শুরু হয়েছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন।
এদিকে মেলাকে ঘিরে মেলা এলাকায় সারা বছরই উৎসবের আমেজ লেগে থাকে। মেলা আসছে ও মেলা গেছে এই আবেগী আনন্দে মেতে থাকেন কয়েক গ্রামের মানুষ। বাংলাদেশের প্রায় ১০/১৫ জেলা থেকে দোকানপাট ও লোকজন এই মেলায় অংশ গ্রহন করেন। গাজীপুর জেলার প্রাচীন এই উৎসব ১৯৬৫ সাল থেকে চালু হয় ও ১৯৭০ সাল থেকে বড় পরিসরে শুরু হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ৫৬ বছর অতিবাহিত করেছে। সংঘাতময় রাজনীতির সময়েও সরকারের কোন সহযোগিতা ছাড়া আপন ব্যবস্থাপনায় লাখো মানুষের ৭২ ঘন্টা এক সাথে শান্তি বজায় রেখে অবস্থা করার এই নজীর বাংলাদেশে হতে পারে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল আলোকিত উদাহরণ।