বাংলাদেশে এক ভয়ানক এবং ব্যাপক দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে

Slider বিচিত্র


বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। সাংবাদিক সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের ১০তম বর্ষপূর্তিতে এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন তারা। এতে এক দশকেও ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ না হওয়া ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করতে ব্যর্থ হওয়ায় জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ জানান। তারা বলেন, দুজন সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের পর এক দশক পার হলেও এখনও কোন বিচার হয় নি। বাংলাদেশে এক ভয়ানক এবং ব্যাপক দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজ করছে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, সাগর সরোয়ার ওমেহেরুন রুনিকে নিজ বাড়িতে তাদের পাঁচ বছরের ছেলের সামনে ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, বাংলাদেশের জ্বালানী খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে কার্যক্রম ও তা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের কারনেই এই দম্পতি ঘাতকদের টার্গেটে পরিণত হন। ২০১২ সালে উচ্চ আদালত র‍্যাবকে এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন। এরপর ২০২১ সালের ২৪শে নভেম্বর উচ্চ আদালত ৮৪তম বারের মত র‍্যাবকে তাদের তদন্তের ফলাফল জমা দিতে বলেন।
যা এখনও সম্পন্ন হয় নি।

এ নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া অপরাধের বিচার না হলে তা অপরাধীদের উৎসাহিত করে। তারা গণমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে চায়। এই বিচারহীনতার কারণে পরে আরও হামলা, ভীতি ও হত্যার পথ প্রশস্থ হয়। আমরা বাংলাদেশে সেই গভীর উদ্বেগের নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। একইসঙ্গে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা বিচারে আটক, হামলা, অপহরণ, অনলাইন ও অফলাইনে ভীতিপ্রদর্শন এবং আইনী হয়রানি চালানোর অসংখ্য প্রতিবেদন পেয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞগণ।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া ঘটনাগুলির তদন্ত বা বিচার হয় নি বললেই চলে। কিছু আক্রমণের ঘটনায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি জড়িত বলে ধারনা করা হয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের সামনে নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ হাজির করলেও প্রায়ই তার কোন জবাব মেলে না। ২০১২ সালে সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো চিঠির কোন জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায় নি।

এছাড়া ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহজাদপুরের তৎকালীন মেয়রের বিরুদ্ধে গুলি করে সাংবাদিক ও মানবাধিকারর্মী আব্দুল হাকিম শিমুলকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ওই মামলার বিচারকার্য বারবার বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞগণ। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় মামলাটির সকল আসামী বর্তমানে জামিনে আছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনা করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়েছিল লেখক মুশতাক আহমেদকে। ৯ মাসের প্রাক-বিচারিক আটকাবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলখানায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যু নিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। যদিও তার পরিবার মনে করে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং অসুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিতে তিন ঘন্টা বিলম্ব করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় গঠিত অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি পরিবারের দাবীর বিষয়ে তদন্ত না করেই তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে সাব্যস্ত করে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞগণ সরকারের কাছ থেকে কোন জবাব পায় নি।

বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আক্রমণ, ভীতি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সহজাত ঝুঁকি থেকে সাংবাদিকতা মুক্ত থাকা উচিৎ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দোষীদেরকে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারার সরকারি ব্যর্থতার কারনে সেটাই বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবৃতির শেষে বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছে সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সম্পূর্ণ, দ্রুত, বিশদ, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত পরিচালনার মাধ্যমে দোষীদেরকে বিচারের সম্মুখীন করার আহবান জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *