গাজীপুরের সাফারি পার্ক দুর্নীতির অভয়ারণ্য

জাতীয়

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রাণীর মৃত্যু নতুন নয়। তবে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ১১টি প্রাণীর মৃত্যু আগে কখনও হয়নি। অস্বাভাবিক ঘটনাটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে পার্কে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য। দেখা গেছে, বন্যপ্রাণীর পরিবর্তে পার্কটি এখন দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। অনিয়ম, অবহেলা ও সমন্বয়হীনতার কারণে মাঝেমধ্যেই প্রাণী মারা যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রায় চার হাজার প্রাণী আছে। এদের খাবারের ব্যবস্থাপনাতেই দেখা গেল বড় ধরনের গলদ। গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সামনে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, এখানে প্রাণীদের খাবার খাওয়ানোর আগে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। কারণ, খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের সুবিধা নেওয়া হয়। ফলে অধিকাংশ সময়ই নিম্নমানের খাবার প্রাণীদের খাওয়ানো হয়। তাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল সরেজমিন পরিদর্শনেও।
সাফারি পার্কে প্রাণীর খাবারের জন্য দৈনিক ১২০ কেজি গরুর মাংসের প্রয়োজন হয়। মাংস সরবরাহ করে তামাম করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। গতকাল বুধবার বিকেলে দেখা যায়, বস্তায় ভরে একটি পিকআপ ভ্যানে করে মাংস আনা হয়েছে। মাংসগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে না মেপে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রাস্তার ওপর ধুলাবালির মধ্যে পলিথিন বিছিয়ে ছোট টুকরো করা হচ্ছে। এই খাবারই দেওয়া হয় প্রাণীদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের কয়েকজন কর্মী জানান, মাংসগুলো মৃত না জীবিত পশুর-তা তদারকি করার কেউ নেই।
যে পরিমাণ মাংস দেওয়ার কথা তাও তারা দেয় না। ঠিকাদাররা নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করলেও কর্মচারীরা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমানের ভয়ে কিছু বলতে পারেন না।
সাফারি পার্কের একজন কর্মকর্তা জানান, খাবার পরীক্ষা করার মতো কোনো কর্মকর্তা এখানে নেই। নেই তেমন যন্ত্রপাতিও। পুরো পার্কে প্রাণীদের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র একজন।
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাণী অসুস্থ হলে বা শারীরিক সক্ষমতা ঠিক আছে কিনা সেসবের দিকে নজর দেওয়া হয় না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে জনবল সংকট একটি বিষয়, তবু মানসিকতাতেই বড় ঘাটতি।
পার্ক কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেনের বক্তব্যেও। তিনি গত রোববার পার্ক পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পার্কের প্রাণীগুলোর মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি রয়েছে। এমনকি পার্কের প্রাণী পাচারও হয়ে যায়।
সাবেকের ছায়া বর্তমানেও :পার্কটি প্রতিষ্ঠার সময় প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ড. তপন কুমার দে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার হাত ধরেই শুরু হয় দুর্নীতির পথচলা। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি পার্কের ভেতরের রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে তখনই। পরে সংস্কার করা হলেও তা টেকেনি বেশি দিন।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ড. তপন কুমার দে এখনও পার্কে ব্যবসা করছেন। চলতি বছরও তার মালিকানাধীন ‘স্বপ্না দে এন্টারপ্রাইজ’ ৫৮ লাখ টাকায় পাখিশালা এবং ১৭ লাখ টাকায় ময়ূরশালা ইজারা নিয়েছেন। ড. তপন নিজেই এটা দেখভাল করেন। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো টিকিটের দাম রাখছেন দর্শনার্থীর কাছ থেকে।
এসব বিষয়ে জানতে ড. তপন কুমার দেকে বারবার ফোন ও মেসেজ দেওয়ার পরও জবাব পাওয়া যায়নি।
ভারপ্রাপ্তের ভার :পার্কে প্রবেশের প্রধান ফটক পেরোলেই উত্তর দিকে রয়েছে টাইগার ও লায়ন রেস্টুরেন্ট। এ দুটি ইজারা নিয়েছে আকরাম হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর মেসার্স মাইছা এন্টারপ্রাইজ। রেস্টুরেন্টের সামনে বাইরের অংশে আকাশমণি বাগানের ভেতরে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয় প্যান্ডেল। যদিও প্যান্ডেল তৈরি করার কোনো নিয়ম নেই। তবু দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ করে’ এটা চলছে। এই প্যান্ডেলের জন্য বেশ কয়েকটি বড় গাছও কাটা হয় বলে জানালেন সংশ্নিষ্টরা।
এ ছাড়া দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষে রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি লাকড়ি দিয়ে রান্নার জন্য তৈরি করা হয়েছে চুলা। কাঠের লাকড়ি দিয়ে সেখানে চারটি চুলায় নিয়মিত রান্না হয়। চুলার ধোঁয়া সরাসরি চলে যায় বাঘ ও সিংহের বিচরণভূমিতে।
মাইছা এন্টারপ্রাইজের মালিক আকরাম হোসেন বলেন, প্যান্ডেল খুলে ফেলা হয়েছে। দুটি রেস্টুরেন্টে ২০০ মানুষের বেশি বসানোর সক্ষমতা নেই। তাই দর্শনার্থীদের খাওয়ানোর সুবিধার জন্য বাইরে প্যান্ডেল করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই এটা করা হয়েছিল।
ইকবাল হোসেন নামের এক ঠিকাদার বলেন, সব টেন্ডার অনলাইনে দেওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ টেন্ডার দেওয়া হতো এনালগ পদ্ধতিতে। টাকা না দিলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো ঠিকাদারের বিলে স্বাক্ষর করেননি।
এই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেন সহকারী বন সংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান। পার্কে ৩ বছর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। জেব্রা মৃত্যুর ঘটনায় গত সোমবার তাকে বদলি করা হয়।
পার্কের প্রধান ফটকের বাইরে গাড়ি রাখার জায়গায় কোনো দোকানপাট না রাখার নিয়ম থাকলেও সেখানে শতাধিক অস্থায়ী দোকান বসানো হয়েছে। একজন দোকানি বলেন, পার্কের বড় স্যারকে এক লাখ করে টাকা দিয়ে তারা এখানে ব্যবসা করছেন।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন সদ্য অব্যাহতি পাওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি এই পার্ককে। সব অভিযোগই অসত্য ও বানোয়াট।’
ব্যয় হয়েছে, কিন্তু বাগান নেই :গাড়ি কেনার জন্য অর্থ খরচ হলেও সেই গাড়ির দেখা মিলছে না; যতগুলো শটগান কেনা হয়েছে, ততগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্পের আওতায় কলাবাগান সৃজন করতে ৫ লাখ টাকা এবং বাঁশবাগান সৃজন করতে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই বাগান দুটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন অনেক অনিয়ম ধরা পড়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিদর্শনেই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের সেই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে আরও অনিয়ম রয়েছে কি না তা খুঁজে দেখতে বলা হয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে কোনো তদন্ত করেনি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রকল্পটির আওতায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০টি শটগান ও ৬০০টি কার্তুজ কেনার কথা ছিল। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২০টি শটগান দেখাতে পারেনি। প্রকল্পের আওতায় দুটি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ ভ্যান কেনার কথা বলা হলেও পরিদর্শনে একটি গাড়ি পাওয়া গেছে।
‘কঠোর অবস্থানে আছি’:পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবিরকে প্রত্যাহার করে তার স্থলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, ঢাকার বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমকে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলাকালে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, জেব্রা ও বাঘের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। অবহেলায় কিংবা অন্য কোনো কারণ থাকলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *