সংবিধানে নির্দেশনা থাকলেও ৫০ বছরে যা হয়নি, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে ২০১২ ও ২০১৭ সালে প্রদত্ত প্রস্তাবে অঙ্গীকার রাখলেও এত বছর সরকারে থেকে আওয়ামী লীগ যা করেনি, কয়েক সপ্তাহ আগেও যা সময়াভাবে করা সম্ভব নয় বলা হয়েছে, সেই নির্বাচন কমিশন গঠনের একটি আইন এখন হুটহাট করে করা হচ্ছে। নানা বিতর্ক সঙ্গী করেই আজ রোববার সংসদে উঠতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বহুল আলোচিত খসড়া আইন। বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত আইনকে অপূর্ণাঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকেই বলছেন, অংশীজনের মতামতকে উপেক্ষা করে এভাবে পাস করলে আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। চলতি অধিবেশনেই আইনটি পাসের বিষয়টি ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগেই রাষ্ট্রপতিকে নতুন ইসির নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আইনটি সংসদে উত্থাপন থেকে শুরু করে গেজেট প্রকাশের জন্য হাতে সময় রয়েছে মাত্র চার সপ্তাহ। কয়েক মাস আগ থেকেই আইনমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতারা বলে আসছিলেন, হাতে সময় কম। তাই নতুন আইন পাস করে ইসি গঠন সম্ভব হবে না। আগের দু’বারের মতো এবারেও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন ইসি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বঙ্গভবনে সংলাপেরও আয়োজন করা হয়। তবে সংলাপে অংশ নিয়ে সরকারের মিত্র দলগুলোসহ বেশিরভাগের পক্ষ থেকেই নতুন আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে। সরকারের আকস্মিক এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বিষয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন কেউ কেউ।
সরকারবিরোধী সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে ‘তামাশা’ বলে অভিহিত করেছে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আইনের খসড়া না দেখে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও খসড়া আইনের বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্কভুক্ত প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ইসি গঠনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া রয়েছে। বাংলাদেশে ওই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।
সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সংবিধানের এমন স্পষ্ট নির্দেশনার পরও ১৯৭২ সাল থেকে কোনো আইন ছাড়াই ইসি গঠন হয়ে আসছে। এর আগে দুইবার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দুটি সার্চ কমিটি গঠন করে সে দুটির সুপারিশের ভিত্তিতে দুটি কমিশন গঠিত হয়। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। এমনকি বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ।
সংসদে উঠছে আজ: আজ সকাল ১১টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনের মুলতবি বৈঠক শুরু হতে যাচ্ছে।
গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আজ রোববারের কার্যসূচিতে দেখা গেছে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ উত্থাপন করবেন। এর পর তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করবেন। সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরীক্ষা করে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনের জন্য খুব বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ হবে না। দ্রুত বিলটি পাস করা হবে। গত সোমবার প্রস্তাবিত আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়।
অনেক অপূর্ণতা: গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সাবেক সিইসি ড. শামসুল হুদা বলেছেন, ইসি গঠন আইনে অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটির অনেক সংশোধন করতে হবে। ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে’ শীর্ষক এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আস্থার অভাব ছিল। আরও তদারকির দরকার ছিল। এত তাড়াহুড়ার প্রয়োজন ছিল না। এই আইনের খসড়া পড়ে মনে হয়েছে, এটি সার্চ কমিটি গঠনের খসড়া।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের মতো জায়গায় আমাদের অন্তত সৎ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ প্রয়োজন। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে এবং তিনি অব্যাহতি পান, তাহলে তাকে নিয়োগ দিতে বাধা নেই। এটি আমার কাছে ভালো লাগেনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে শামসুল হুদা বলেন, প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে জনগণেরও মতামত নেওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এমন একটি আইন হলে এটির যোগ্যতা প্রমাণ করা উচিত।
তিনি বলেন, ৫০ বছরে অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। তাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে। বিগত ৫০ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল চায়নি একটি ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক।
সার্ক দেশগুলোর দৃষ্টান্ত: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ভারত ছাড়া ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানে সংবিধানের আলোকে প্রণীত আইনে প্রতিষ্ঠিত কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। ওইসব দেশে ইসি গঠন নিয়ে তেমন কোনো বিতর্কের কথা শোনা যায় না।
সুশাসনের জন্য নাগিরক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সরকারের প্রস্তাবিত আইনে আগের দুই নির্বাচন কমিশনকে আইনি বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সার্চ কমিটিকে আইনি খোলস পরিয়ে মানুষের মূল দাবি থেকে দৃষ্টি আড়ালের চেষ্টা করা হচ্ছে। অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন না ঘটলে আইন পাস হলেও কোনো কাজে আসবে না। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইসি গঠন প্রক্রিয়া অনুসরণেরও আহ্বান জানান।
বিভিন্ন দেশের ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় সংশ্নিষ্ট দেশের সরকারি ওয়েবসাইট ও অনলাইনে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, পাকিস্তানের আইনে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সম্মতিতে প্রতিটি পদের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়। মনোনীতরা পার্লামেন্টের একটি কমিটির শুনানিতে হাজির হন। ওই কমিটি তাদের মধ্যে একজনের মনোনয়ন অনুমোদন করে এবং প্রেসিডেন্ট তাকেই নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা এসব পদের মনোনয়ন প্রশ্নে একমত হতে না পারলে তারা দু’জনেই আলাদাভাবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করে পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠান। কমিটি তাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নেয়। স্পিকার ওই পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের বাছাই করে ১০ সদস্যের সাংবিধানিক পরিষদ, যে পরিষদের সদস্য হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রেসিডেন্টের মনোনীত একজন, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার যৌথ প্রস্তাবে মনোনীত ও প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত পাঁচজন এবং এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত এমন একজন, যিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার দলের সদস্য নন।
নেপালে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সদস্য প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। কাউন্সিলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে সংসদে আলোচনা এবং গণশুনানির পর চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর প্রধান ও বাকি চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ভুটানে এসব পদে নির্বাচনের জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে। এই পর্ষদের নেতৃত্বে রয়েছেন সংসদের উচ্চকক্ষ ন্যাশনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। পর্ষদের সদস্য হিসেবে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা। এই পর্ষদ প্রস্তাবিত সব নাম পর্যালোচনা করে তাদের নির্বাচিত নামের তালিকা রাজার কাছে পাঠায়। রাজার মাধ্যমে নিয়োজিত হয় নির্বাচন কমিশন।