যে কারণে খুন হন সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জানালো র‌্যাব

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


রাজধানীর শ্যামলীতে জনবহুল সড়কে প্রকাশ্যে বাংলাদেশ গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গ্রেপ্তারকৃতদের নাম- মো. সাইফুল ইসলাম ও মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেন। আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‍্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, গত ১১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার পর শ্যামলীর হলি লেন গলিতে দুর্বৃত্তরা গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদকে (৭২)নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয়রা আনোয়ার শহীদকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের ছোট বোন ফেরদৌস সুলতানা (৫৯) রাজধানীর আদাবর থানায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তিনি আরও জানান, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‍্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে গত ১৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী (১) মো. জাকির হোসেন (৩৭) এবং হত্যাকারী (২) মো. সাইফুলকে (২৬)গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করে।

এজাহার সূত্রে জানা যায় যে, ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যক্তি আনোয়ার শহীদ (৭২) একজন অবসরপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি গম গবেষণা কেন্দ্রে ১৯৭৬ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৮ সালে পরিচালক পদ মর্যাদায় প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মস্থল জয়দেবপুর থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষতা সম্পন্ন কর্মকর্তা ছিলেন। চাকুরী জীবনের সবটুকু সময় তিনি গবেষণার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কর্মস্থলে এবং সামাজিকভাবে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিহত আনোয়ার শহীদ ১৯৮৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও মাসখানিক পরেই তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি এবং তার কোনো সন্তান নেই। অবসর গ্রহণের পূর্বে এবং পরে ভিকটিমের গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার ডোমারে বিভিন্ন সময় দরিদ্র এবং অসহায় আত্মীয় স্বজনকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন বলে জানা যায়।

অবসরের পর হতে তিনি তার ছোট বোন এবং মামলার বাদী ফেরদৌস সুলতানার সাথে তার কল্যাণপুরস্থ বাসায় বসবাস করতেন। অবসর গ্রহণের পরে পেনশনের টাকা হতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি দিনাজপুর জেলায় একটি জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করেন এবং তা ভাড়া দেন। তিনি চাকুরীকালীন সময়ে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় কর্মরত ছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেনের পরিচয় হয়।

গত ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার নিহত আনোয়ার শহীদ তার পূর্ব পরিচিত একজন ব্যক্তির সাথে দেখা করতে শ্যামলীতে একটি বাস কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। ওই ব্যক্তির সাথে দেখা করে প্রত্যাবর্তনের সময় শ্যামলীর হলি লেন গলিতে আসলে তিনি দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সন্ধ্যা ১৯০০ থেকে ১৯১৫ ঘটিকায় বর্ণিত গলিতে মুখে মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ পরে একজন লোক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। ভিকটিম আনোয়ার শহীদ প্রধান সড়ক হতে গলিতে প্রবেশের সাথে সাথে ওই দুর্বৃত্ত তার দিকে এগিয়ে যায় এবং পকেট থেকে ছুরি বের করে ভিকটিমের পেটে ছুরিকাঘাত করে সরে যায়। ভিকটিমকে রাস্তার মাঝখানে পড়ে যেতে দেখে ছুরিকাঘাতের বিষয়টি পথচারীরা বুঝতে পারলে হত্যাকারীকে দ্রুত সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।

হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী গ্রেপ্তারকৃত আসামি জাকির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে,নিহত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদ দিনাজপুর শহরে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার সাথে পরিচয় হয় যা পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। দিনাজপুরে ভিকটিম কর্তৃক জমি ক্রয়ের সময় জাকির দালাল হিসেবে মধ্যস্থতা করে। এছাড়াও নিহত আনোয়ার শহীদের নিকট হতে বিভিন্ন সময়ে জাকির ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে গ্রহণ করে। ভিকটিম অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো। গত ১ বছর পূর্বে জাকির তার চালের গোডাউন বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা লোন পাইয়ে দিতে ভিকটিমের সহযোগিতা চায়। ভিকটিম তাকে সহযোগিতা করতে অপারগতা জানায়।

ভিকটিম গত ১ বছর যাবৎ তার পাওনা ১২ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তারকৃত জাকিরকে চাপ দেন।

সেই টাকা লেনদেন সম্পর্কে নিহত আনোয়ার শহীদ ও জাকির ছাড়া কেউ জানতো না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাকির গত ৬/৭ মাস যাবৎ আনোয়ার শহীদকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। তাতে তার ধারকৃত টাকা দেয়া লাগবে না। জাকির হত্যাকাণ্ডের ৩/৪ মাস পূর্বে ১ বার আনোয়ার শহীদকে তার পূর্ব পরিচিত ধান/চালের চাতাল শ্রমিক মো. সাইফুলকে দিয়ে পরিকল্পনা করে ঢাকায় হত্যার চেষ্টা করে।

গ্রেপ্তারকৃত আসামি মো. সাইফুল’কে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায়, সে একসময় জাকিরের চালের গোডাউন কাজ করতো। সে একজন নিয়মিত মাদকসেবী এবং মাদক ক্রয়ের জন্য তার প্রায়শই টাকার প্রয়োজন হতো। জাকিরের গোডাউনে কর্মরত থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে জাকির সাইফুলকে অর্থ সহায়তা করতো। গত ৩/৪ মাস পূর্বে জাকির সাইফুলকে ঢাকায় আসতে বললে সাইফুল ঢাকায় আসে।

এসময় জাকির সাইফুলকে বলে যে, একজন লোক আর্থিকভাবে তাকে অনেক বড় ধরণের ক্ষতি করেছে এবং তাকে হত্যা করতে হবে। সাইফুল যদি ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে জাকির সাইফুলকে জায়গাসহ বাড়ি, অর্থ সহায়তা প্রদান করবে এবং পূর্বের প্রদানকৃত টাকা পরিশোধ করতে হবে না। সে সময়ে জাকির সাইফুলকে একটি ছুরিও কিনে দেয় আনোয়ার শহীদকে হত্যা করার জন্য। জাকিরের প্ররোচনায় সাইফুল ইতিপূর্বেও আনোয়ার শহীদ’কে হত্যার চেষ্টা করে কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং পুলিশের উপস্থিতির কারণে তারা ব্যর্থ হয়।

এছাড়াও গ্রেপ্তারকৃত সাইফুল এবং জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, সাবেক বৈজ্ঞানিক আনোয়ার শহীদ’কে হত্যার এই ধারাবাহিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১১ নভেম্বর ২০২১ তারিখ সকালে জাকির ও সাইফুল দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে কল্যাণপুরে একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে। হোটেলের কক্ষে বসে জাকির এবং সাইফুল ভিকটিমকে হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাকির হোটেলের পাশের গলির দোকান থেকে ১৮০ টাকা দিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি ক্রয় করে। ওই দিন সন্ধ্যায় পূর্ব নির্ধারিত সময় এবং স্থানে ভিকটিম জাকির এর সাথে দেখা করতে আসলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার কথা বলে ভিকটিমকে স্থানীয় একটি মার্কেটে নিয়ে যায়। জাকির কেনাকাটা শেষ করে শ্যামলীর হলি লেন গলিতে ভিকটিমকে নিয়ে আসে এবং সাইফুল এর উদ্দেশ্যে ইশারা করে।

গলিতে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সাইফুল এসময় ভিকটিম এর নিকট এগিয়ে যায় এবং ছুরিকাঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যায়। এসময় জাকির ভিকটিম এর পাশেই অবস্থান করছিল এবং সিসিটিভি ফুটেজে ভিকটিমকে হাত ধরে মাটিতে শুইয়ে দিতে দেখা যায়। আহত ভিকটিম মাটিতে শুয়ে পড়লে পথচারীরা চারপাশে ঘিরে ধরে এবং এই সুযোগে জাকির ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে দেখা যায়। হত্যাকান্ডের পর গ্রেপ্তারকৃত জাকির এবং সাইফুল হোটেলে প্রত্যাবর্তন করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রেস চেঞ্জ করে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে গমনের জন্য হোটেল থেকে বের হয়ে যায়। এসময় দিনাজপুর থেকে একজন ব্যক্তি জাকির’কে ফোন দিয়ে আনোয়ার শহীদ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে বলে জানায়।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে সে ভিকটিমকে দেখার জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যায়। এরপর দিনাজপুরে চলে যায়।

গ্রেপ্তারকৃত জাকির মূলত একজন ব্যবসায়ী এবং জমির দালালি করে। দিনাজপুরে তার একটি চালের গোডাউন আছে। আর গ্রেপ্তারকৃত সাইফুল একজন নিয়মিত মাদকসেবী। সে জমি, বাড়ি এবং অর্থের লোভে হত্যাকান্ডে জড়িত হয় বলে স্বীকার করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *