জেলখানায় সেনা সদস্যের উপস্থিতি কারা কর্তৃপক্ষের জন্য অনভিপ্রেত ছিল এবং সে কারণে তারা ইতস্তত করছিল। তাদের ইতস্তত ভাব শেষ হলো প্রেসিডেন্টের নির্দেশ আসার পর। অবৈধ প্রেসিডেন্ট অবৈধ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজেই জেলহত্যার প্রধান আসামি খন্দকার মোশতাক
জেলহত্যা ঘটনাটি কী ছিল? ঘটনাটি কেন ঘটেছিল? ঘটনার পরবর্তী ফলাফল কী হয়েছিল। মোটামুটি এই তিনটি প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে জেলহত্যা সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, কারাগারের বন্দি এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকা মানুষকে হত্যার দৃষ্টান্ত আর নেই। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে তা ঘটেছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মোহাম্মদী বেগ বন্দি অবস্থায় হত্যা করেছিল। সেই রাজরাজড়ার আমলে এমন হত্যা খুব একটা kalerkanthoরীতিবিরুদ্ধ ছিল না; কিন্তু আধুনিক যুগে এমন জেলহত্যা বিপন্ন বিস্ময়ের কারণ ছিল। তা-ও আবার স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর দ্বারা জাতীয় চার নেতা হত্যার মতো ঘটনা। অবশ্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করে পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত এই সৈনিকরা হাত পাকিয়েছিল ও সাহস সঞ্চয় করেছিল। উপরন্তু স্মর্তব্য, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের বিচারে ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ছিল এবং ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের আশু কারণ হিসেবে যা-ই কিছু উল্লেখ করা হোক না কেন, তা সত্ত্বেও।
৩ নভেম্বর রাত দেড়টা-দুইটার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সেনাসহ একটি পিকআপ এসে থামে। ওই অসময়ে সেখানে সেনা উপস্থিতির কারণ ছিল না; অন্তত কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য তা-ই। অবশ্য কারণ জানা গিয়েছিল কিছুক্ষণের মধ্যে, যা ছিল ঘৃণ্য, লোমহর্ষক এবং মর্মন্তুদ।
রাত দেড়টার দিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেলার আমিনুর রহমান কারাগারে আসেন। তখন তাঁর কক্ষে ফোন বাজলে তিনি রিসিভার তুললেন; অন্য প্রান্ত থেকে তাঁকে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন পুলিশের আইজির সঙ্গে। আইজির সঙ্গে পুতুল প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কথা হলো। আইজির ভাষ্য ছিল, ‘প্রেসিডেন্ট বলেছে, আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা করো।’ ঘটনা যেভাবে ঘটেছিল, তা থেকে দুটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। এক. জেলখানায় সেনা সদস্যের উপস্থিতি কারা কর্তৃপক্ষের জন্য অনভিপ্রেত ছিল এবং সে কারণে তারা ইতস্তত করছিল। দুই. তাদের ইতস্তত ভাব শেষ হলো প্রেসিডেন্টের নির্দেশ আসার পর। এটা অনুমেয় যে বঙ্গভবন দখলকারী মেজরদের হুকুম তামিল করেছিলেন মাত্র মোশতাক, কারণ তিনি তাঁদের আজ্ঞাবহ ছিলেন। তবে এটা সন্দেহাতীত যে জেলহত্যার চূড়ান্ত নির্দেশ এসেছিল প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। অবৈধ প্রেসিডেন্ট অবৈধ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজেই জেলহত্যার প্রধান আসামি খন্দকার মোশতাক।
যা হোক, ঘটনা চলমান অবস্থায় রাত ৩টা বেজে যায়। এমন সময় সেনারা নির্দেশ দেয় চার জাতীয় নেতাকে একত্র করতে। কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চারজনের নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন। চার জাতীয় নেতা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। আমিনুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ একটি কক্ষে এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান অন্য কক্ষে ছিলেন। সবাইকে প্রথম কক্ষে জড়ো করা হলো।
আমিনুর রহমান তাঁর ভাষ্যে বলেছেন, তাজউদ্দীন তখন কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হাত-মুখ ধুলেন। কেউ কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেননি, তাঁদের কেন এমন করা হচ্ছে। অবশ্য আমিনুর রহমান বলেছিলেন, ‘আর্মি আসছে।’ একত্র করার কাজে কিছুটা সময় লাগছিল; এতে অধৈর্য ও ক্ষিপ্ত সেনাদের মুখ থেকে ছুটেছিল অশ্রাব্য গালাগাল। এরপর তো ব্রাশফায়ার! চার জাতীয় নেতা অকালপ্রয়াত হলেন। আওয়ামী লীগ বা বাকশালের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আর কেউ বেঁচে থাকলেন না। তাঁদের হত্যা করতে গুলি ও সঙিন দুটিই ব্যবহার করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীরা অভিন্ন দল ছিল।
কেন এই হত্যাকাণ্ড? বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক সেনা কর্মকর্তা (যেমন—প্রয়াত মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী ও ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন) প্রধানত দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এক. সেনাবাহিনীতে নেতৃত্বের টানাপড়েনের পরিণতি। দুই. পাল্টা অভ্যুত্থান হলে (যা ৩ নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে হয়েছিল) আওয়ামী লীগ জনসমর্থন পাবে। সে ক্ষেত্রে বন্দি চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখা সমীচীন হবে না। এমন ব্যাখ্যাগুলো গ্রহণযোগ্য হলেও সমান্তরালে কিছু ব্যাখ্যার সংযোজন কাম্য। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুসহ চার জাতীয় নেতা অপরাধ করেছিলেন (খুনিদের দৃষ্টিতে) বাংলাদেশ সৃষ্টির অনুঘটক হয়ে। কাজেই পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত ও পাকিস্তানমনস্ক খুনিদের লক্ষ্য ছিল তাঁদের হত্যা করা। আর জানা কথা, পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ তো মিনি পাকিস্তান হতে চলেছিল। উপরন্তু ডানপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী মোশতাক খুনিদের পছন্দের ছিলেন। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে চার জাতীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনা করে আরো বড় অপরাধ করেছিলেন। উপরন্তু ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে চার নেতা মোশতাকের সহযাত্রী হলে তাঁরা বন্দি হতেন না বা তাঁদের প্রাণও দিতে হতো না।
২০০৪ সালে প্রায় ২৯ বছর পর জেলহত্যার বিচার শুরু হয়। ২০ অক্টোবর তিনজন পলাতক সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড হয়। ১২ জন সেনা কর্মকর্তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বোধগম্য কারণে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বিএনপির চার সিনিয়র নেতাসহ পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট ২০০৮ হাইকোর্ট জেলহত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছয় সামরিক কর্মকর্তাকে খালাস দেন, যাঁদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে ২০১০-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়। যাঁরা খালাস পেয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন আছে। বিচারটি অসমাপ্ত।
১৫ আগস্ট নিয়ে যেমন, তেমনি ৩ নভেম্বর নিয়েও তদন্ত কমিশন করা উচিত। রাষ্ট্রের স্বার্থে তা করতে হবে।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)