ন্যায় বিচার না পাওয়াদের মডেল হয়ে এলেন পরীমনি!

Slider বাংলার আদালত


ঢাকা: বিভিন্ন কারণে যারা ন্যায় বিচার পান না, তাদের জন্য মডেল হয়ে এলেন পরীমনি। অনেকটা সিনেমার স্টাইলেই পরীমনির গ্রেফতার, রিমান্ড, জামিন ও জামিন-রিমান্ড চ্যালেঞ্জের আইনী উদ্যোগ। দেখা গেলো, উচ্চ আদালত রিমান্ড চাওয়া ও দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করে আদেশ দিলেন। রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুরের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ না করার কারণে উচ্চ আদালত রিমান্ড চাওয়ার কারণে তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব ও রিমান্ড দেয়ার কারণে বিচারককে ব্যাখা দিতে বললেন। ১৫ সেপ্টম্বর এই চাওয়া পাওয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানা গেলো।

খবরে বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরের কারণ জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। কিসের ভিত্তিতে ওই দুই দফা রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা জানিয়ে ঢাকার দুটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে ১০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে নথিসহ (কেস ডকেট) ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। দেরিতে জামিন আবেদন শুনানির তারিখ নির্ধারণ নিয়ে পরীমনি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। এর শুনানিতে পরীমনিকে রিমান্ড নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ওই মামলায় দ্বিতীয় দফায় ১০ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস এবং তৃতীয় দফায় ১৯ আগস্ট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম ওই রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। হাইকোর্ট বলেছেন, ব্যাখ্যার জবাব সন্তোষজনক না হলে তাঁদের আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হতে পারে।

মামলাটি তদন্ত করছেন পুলিশ পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফা। আদালত বলেছেন, রিমান্ড চাওয়ার কারণ ও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ১৫ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে হবে।

যে কারণে দুই বিচারকের ব্যাখ্যা ও তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব

আদালত বলেন, নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ও আইন লঙ্ঘন করে বেআইনি পন্থায় অভিযুক্ত পরীমনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবে নাগরিকের অধিকার বেআইনি পন্থায় খর্ব করা যায় না। একইভাবে প্রতিটি নাগরিকের আইন ও আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি অনুগত থাকতে হয়। বর্তমান মামলায় যে পন্থায় তাঁকে (পরীমনি) গ্রেপ্তার, আদালতে হাজির এবং হাজিরের পর চার দিনের জন্য রিমান্ডে পাঠানো হয়, তাতে অভিযুক্তর নিরাপত্তা ও অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করে আদালত বলেন, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।

আদালত বলেন, সুষ্ঠু ও স্বাধীন তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই স্বীকার করতে হয়। বর্তমান মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করেন। গত ১০ ও ১৯ আগস্ট রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুরের আগে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে সন্তুষ্ট হলেন? প্রথম দফায় চার দিন রিমান্ডের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা এমন কী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাদান পেলেন যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সংবিধান ও অন্যান্য আইনি বিধিবিধান লঙ্ঘন করে তদন্ত কর্মকর্তার করা রিমান্ড আবেদনে ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, তা বোধগম্য নয়।
ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে ঘোষিত আদেশে বলা হয়, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (দুজন) কারণ ব্যাখ্যা করবেন, কিসের ভিত্তিতে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলো।

আদালত আরও বলেন, অপরাধ এককভাবে পুলিশের জন্য সমস্যা নয়, সমাজের সমস্যা। কারও রিমান্ড চাওয়ার আগে পুলিশ কর্মকর্তাকে আইনি ও মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথমে চিন্তা করতে হবে। সিডিসহ তদন্ত কর্মকর্তাকে ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হতে বলা হলো। পরবর্তী আদেশের জন্য ১৫ সেপ্টেম্বর দিন রাখা হলো।

এর আগে আদালতে পরীমনির পক্ষে আইনজীবী মো. মজিবুর রহমান শুনানি করেন। আসকের নির্বাহী সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুনানি করেন, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন ও মো. শাহীনুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান। এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।

সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান শুনানিতে বলেন, প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট চারদিন রিমান্ড দেন। একদিন রিমান্ডের পর বিষয়টি তদন্তের জন্য সিআইডিতে যায। রিমান্ডে একদিন ডিবির হাতে ও পরের তিনদিন সিআইডির কাছে থাকে। ১০ আগস্ট রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হয়। তখন তারা দুদিন রিমান্ড চান, যেখানে বলা কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া গেছে ও উনি কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। সেদিন ম্যাজিস্ট্রেট দুইদিন রিমান্ড দেন।

এ সময় আদালত বলেন, সিআইডি কাছে তিনদিন ছিল, তারা তো কারা জড়িত তেমন কোনো তালিকা তো দেয়নি।

তখন সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, যখন একটি বিষয় তদন্তাধীন থাকে, তদন্তের স্বার্থে তারা অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারেন না। তবে তা রেকর্ডে থাকে। দুদিন রিমান্ডে নেওয়ার পর আসামি কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। বিভ্রান্তকর তথ্যের কারণে বাধ্য হয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়। একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়, যা জরুরি ছিল।

আদালত বলেন, অপরাধের গুরুত্ব ও ধরণ বিবেচনায় সাত দিন রিমান্ড লাগবে, আপনি চার দিনে কিছু করতে পারলেন না।

সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, যখন আসামি সহযোগিতা না করে, বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়, তখন তো তদন্ত কর্মকর্তার আর কিছু করার থাকে না। তারা আইনগত ভাবে আদালতের কাছে রিমান্ড চেয়েছ। এমনকি তাকে নির্যাতন করার কোনো অভিযোগও আসামিপক্ষ থেকে আসেনি। সিডিতে কিছু স্পর্শকাতর তথ্য আছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, শুধু পরীমনি নয়। দেশটা কিন্তু দুশ বছরের আগের না। এখানে রিমান্ডে নিয়ে জোর করে আদায় করার কিছু নেই। স্বেচ্ছায় দিলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে গণ্য হবে। জোর করা যাবে না, ভয় দেখানো যাবে না। এই দেশে কেউ কারো প্রজা নয়। এটি ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলও না। হেফাজত ও রিমান্ড সংক্রান্ত আপিল বিভাগের নির্দেশনার প্রসঙ্গ টেনে জেড আই খান পান্না বলেন, এই নির্দেশনা কেন মানবে না ?

আদালত বলেন, ওই সাতদিনের মধ্যে অভিযুক্তকে (পরীমনি) কি কোনো নির্যাতন করা হয়েছে ? তখন জেড আই খান পান্না বলেন, শারীরিক নির্যাতনই নির্যাতন নয়। মানসিক নির্যাতনও নির্যাতন। যতগুলো মানুষের সামনে দিয়ে টেনে হেচরে নিয়ে গেছে, পরে গেছে—এটা কি নির্যাতন হিসেবে দেখবেন না ?

এক পর্যায়ে আদালত বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা বাধ্যতামূলক। কিছু সমস্যা আছে, দীর্ঘদিনেও মানসিক ও অবকাঠামোগত ভাবে তা উন্নত হয়নি।

জেড আই খান পান্না বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করুক, তা জেলগেটে করতে পারে। যদি সেফহোমে মানবতাবিরোধীদের চিকিৎসক, আইনজীবীর ও আত্নীয়স্বজনের সামনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিতে পারে, তাহলে পরীমনিসহ অন্যদের ক্ষেত্রে কেন নয় ?

পরীমনির আইনজীবী মো. মজিবুর বলেন, রিমান্ড আইনি কার্যক্রম। এটি উপেক্ষা করছি না। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৭ ধারায় রিমান্ড নেওয়ার উদ্দেশ্য বলা আছে। তবে মানুষের জীবন ও স্বাধীনতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। ১৬৭ (৩) ধারার আছে রিমান্ড মঞ্জুরের কারণ উল্লেখ করতে হবে। সর্বশেষ রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশে সার্বিক বিবেচনার কথা উল্লেখ করা হয়। এর আগেরটিতে যৌক্তিক কারণে দুদিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে বলা হয়। এটি কারণ ব্যাখ্যার পর্যায়ে পরে না।

এর আগে পরীমনিকে ৪ আগস্ট রাতে তাঁর বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে আটক করে র‌্যাব। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়। এই মামলায় পরীমনিকে তিন দফায় মোট সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরীমনিকে প্রথম দফায় চার দিন, দ্বিতীয় দফায় দুই দিন ও তৃতীয় দফায় এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

১৯ আগস্ট পরীমনির জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এর বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন পরীমনি। ২২ আগস্ট বিষয়টি আদালতে ওঠে। আদালত জামিন আবেদনের শুনানির দিন রাখেন ১৩ সেপ্টেম্বর।

২১ দিন পর জামিন শুনানির দিন ধার্য করা–সংক্রান্ত আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমনি, যার শুনানি নিয়ে ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে জামিন আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জামিন আবেদনের শুনানি দ্রুত (আর্লি হিয়ারিং), তথা দুই দিনের মধ্যে করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এদিকে নিম্ন আদালত জামিন শুনানির দিন এগিয়ে আনেন। ৩১ আগস্ট শুনানি নিয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ পরীমনির জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। পরদিন পরীমনি জামিনে মুক্তি পান।

এ ছাড়া ১ সেস্টেম্বর হাইকোর্টে রুল শুনানির দিন ধার্য ছিল। এর আগে পরীমনিকে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বতঃপ্রণোদিত রুল চেয়ে হাইকোর্টের একই বেঞ্চে আবেদন দাখিল করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ধার্য তারিখ বুধবার ও বৃহসপতিবার শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আদেশ দেন।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে অনেক মানুষ গুম হয়েছেন। নিঁখোজ হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় ফাঁসির ঘরে দীর্ঘদিন থেকে নির্দোষ হয়েও বের হয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলেছে। রিমান্ডে এনে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। মানুষ ধরেই মারপিট করে মেরে ফেলেন, এমন নজীর আছে। আইনশুুঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আইন অমান্যের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু আইন মান্য করার জন্য উচ্চ আদালদত নির্দেশনা অনেক দিয়েছেন কিন্তু পরীমনির ক্ষেত্রে বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে বিজ্ঞ আদালত যে ধরণের সচেতন, তা নিঃসন্দেহে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতে অনেক ভালো উদ্যোগ। চিত্রনায়িকা পরীমনির ক্ষেত্রে আইনের প্রশ্নবিদ্ধ প্রয়োগ ও নিম্ন আদালতের প্রশ্নবিদ্ধ আদেশকে বিচারের আওতায় এনে বিচার করার জন্য উচ্চ আদালতের উদ্যোগ প্রশংসার দাবী রাখে।

মানুষ আশা করে, পরীমনির ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত যে ধরণের উদ্যোগ নিয়েছেন, এই উদ্যোগ সকল নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত থাকলে ন্যায় বিচার কোন দিন বাঁধাগ্রস্থ হবে না।

লেখক,
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *