ঢাকা: দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু আবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণ আরও ব্যাপক আকারে ছড়াতে পারে। এ অবস্থায় সারাদেশ আগামী ১৪ দিনের শাটডাউন করার সুপারিশ করেছে কোভিড ১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। শাটডাউনকালে জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন ও অফিস-আদালতসহ সব কিছু বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি। সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহ থেকেই দেশজুড়ে শাটডাউন শুরু হতে পারে।
করোনা সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকার নানা রকম কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দেশজুড়ে স্থানে স্থানে চলছে এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’। ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে সড়ক, নৌ ও রেলপথ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যেও একদিনে করোনা সংক্রমণ ছয় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৮ জন, যা গত আড়াই মাসের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৮১ জনের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আগামীতে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এতে করে হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির চাপও বেড়ে যাবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রথমে দেশের সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলোতে। এটি এখন সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। এই সামাজিক সংক্রমণের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেড়ে চলছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণ আরও ব্যাপক আকারে ও ভয়াবহ রূপে ছড়িয়ে পড়তে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরও আশঙ্কা, সামনের পরিস্থিতি আরও শোচনীয় অবস্থায় চলে যেতে পারে।
সর্বশেষ, কারিগরি পরামর্শক কমিটির করা শাটডাউনের সুপারিশ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। কারণ দেশে করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, শাটডাউন দেওয়ার বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি আছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনা চলছে। এবার শাটডাউন গত বছরের চেয়ে আরও কঠোরভাবে পালন করা হবে। অন্যথায় করোনা সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা (ভারতীয়) ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় গত ৮ মে। ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এর পর থেকে এর সংক্রমণ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে গত চার সপ্তাহ ধরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। এ ভ্যারিয়েন্টের কারণে সারাদেশে রোগী বাড়ছে। দেশের অর্ধশতাধিক জেলা এখন রয়েছে সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে। এ অবস্থায় সারাদেশ ১৪ দিনের শাটডাউন করার সুপারিশ করেছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার রাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বৈঠক করে। বৈঠকে দেশের করোনার ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ পরিস্থিতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও আলোচনা হয়। সভায় আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ জানান, করোনার বিশেষ ডেল্টা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে এবং দেশে ইতোমধ্যে এর প্রকোপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রজাতির জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারাদেশেই উচ্চ সংক্রমণ, ৫০ বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে। রোগ প্রতিরোধের জন্য খ- খ-ভাবে গৃহীত কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অন্যান্য দেশ, বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এর বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। তাদের মতামত অনুযায়ী যেসব স্থানে পূর্ণ শাটডাউন প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক, স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে।
পরামর্শক কমিটির সভাপতি জানান, প্রধানমন্ত্রী করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য কমিটি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এ রোগ থেকে পূর্ণ মুক্তির জন্য ৮০ শতাংশের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশ থেকে টিকা সংগ্রহ, লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশে টিকা উৎপাদন করা ও নিজস্ব টিকা তৈরির জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার প্রতি কমিটি পূর্ণ সমর্থন জানায়।
বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনায় আক্রান্তের তিনজনের তথ্য পাওয়া যায়। এর পর সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়। ওই সময়ে (পিক টাইম) এক দিনে চার হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হতো, মৃত্যু হতো ৫০-৬০ জনের। সেপ্টেম্বর মাস থেকে করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করে এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোগী ৩০০ জনের নিচে নেমে আসে। কিন্তু গত মার্চ মাসের শুরুতে দেশে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে এবং একদিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়; মৃত্যু পা রাখে শতাধিকের ঘরে। এমতাবস্থায় করোনার সংক্রমণ রোধে ৫ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধ আরোপের পর মে মাসে দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশ খানিকটা কমে এসেছিল। কিন্তু গেল রোজার ঈদে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। তখন শহর ছেড়ে গ্রামে আবার গ্রাম থেকে শহরে আসা-[যাওয়া করেন লাখ লাখ মানুষ। তাদের অধিকাংশই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেছে। এ কারণে শঙ্কা মাথায় রেখে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছিলেন- ঈদের পর সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। কার্যত তা-ই হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। সেই ভ্যারিয়েন্টের কারণে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী বাড়তে থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দেওয়া হয় সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি জেলায়। কিন্তু এর পরও সারাদেশে করোনার বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। সার্বিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণে তাই সারাদেশে শাটডাউনের সুপারিশ করা হয়েছে।