গাজীপুর: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কোচিং সেন্টারও বন্ধ। অথচ সরকারী ও এমপিওভূক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অফিসিয়িাল কার্জক্রমের পাশাপাশি খোলা জায়গায় পাঠাদানও চলছে। বন্ধ প্রতিষ্ঠান মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা ও চক-ডাস্টার কেনার জন্য কোটি কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। এমনকি সরকারীভাবে বন্ধ হওয়া জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনুষ্ঠানের খরচ হিসেবে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে সরকারী আধাসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা ভালোভাবেই জীবন যাপন করছেন। অথচ একই সময়ে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকেরা পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের বাঁচানোর জন্য এক মুঠো ভাত সংগ্রহ করতে বিচ্ছিন্নভাবে দুই-চার জন শিক্ষার্থী পড়ানোর সময় জরিমানার শিকার হচ্ছেন। জরিমানার টাকা দিতে না পারায় শিক্ষকের সম্মানের দিক বিবেচনা করে প্রতিবেশীরাও পরিশোধ করছেন শিক্ষকের জরিমানার টাকা।
সম্প্রতি গাজীপুর শহরের জোরপুকুর পাড় এলাকায় ২জুন বিকেলে একটি কিন্ডারগার্টেনের এক শিক্ষককে প্রাইভেট পড়ানোর দায়ে ভ্রাম্যমান আদালত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। কিন্তু শিক্ষকের কাছে টাকা না থাকায় তাকে আটক করা হয়। সংবাদ পেয়ে প্রতিবেশী বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যার হাতে যা আছে তা মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা পরিশোধ করে মুক্ত করেন শিক্ষককে। একই ধরণের অবস্থা গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে। প্রায়ই কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের জরিমানা করা হচ্ছে এমনকি দন্ডও দেয়া হচ্ছে।
এই অভিযান সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়, জনাব আবুল কালাম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, গাজীপুর এর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে কয়েকটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে আসছিল। অভিযানকালে দেখা যায় অভিভাবকদের উদাসীনতায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোচিং করানো হচ্ছিল। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করায় উদয়ন একাডেমিক হোম এর মালিক আবুল হাসান বাবুকে ৩০ হাজার টাকা ,দুলাল চন্দ্র সরকারকে ৩০ হাজার টাকা এবং সমাপনী কোচিং এর মালিক সোহেল রানাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় । এছাড়াও কয়েকজন অভিভাবককে জরিমানা করা হয় । মাস্ক না পড়ায় একই এলাকার শাপলা গিফট কর্ণার এর ম্যানেজার হাসান আহমেদকে ১০০০/- টাকা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় ও অধিক কাস্টমার রেস্টুরেন্টে বসিয়ে আড্ডা দেওয়ানোয় একটি রেস্টুরেন্টকে জরিমানা করা হয়। মোট ৮টি মামলায় ১ লক্ষ ৬৩ হাজার দুইশত টাকা জরিমানা করা হয়।
ভ্রাম্যমান আদালতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এসময় জনসাধারণ কে মাস্ক পরিধানের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়।
বিজ্ঞজনেরা বলছেন, শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারী বেতন ভাতা ছাড়াও বন্ধ স্কুল ও বন্ধ অনুষ্ঠান দেখিয়ে টাকা নিয়ে আয়েসী জীবন যাপন করছেন আবার আরেক শ্রেনীর শিক্ষক পেটের জ্বলায় নিজ ঘরে গোপনে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে ধরা পরে জরিমানা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিবেশীদের দান-খয়রাতে ও করুনা ভিক্ষায় সম্মান রক্ষা করছেন। একটি পেশার উপর আমাদের বিমাতাসুলভ আচরণ মানুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরীর পাশাপাশি আমাদের মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী যা সংবিধানেরও লঙন। এটা হওয়া উচিত নয়।
২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হলেও পুরোপুরি কার্যকরও হযনি। এখনো বিচারিক ক্ষমতার কিছু অংশ নির্বাহী বিভাগের কাছে রয়েছে। এ ছাড়া বিচার বিভাগের জন্য আলাদা মন্ত্রনালয়ও হয়নি। কিন্তু কাগজে কলমে আইন ও সংবিধানে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়েই চলছে। বর্তমানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন বলতে বাধ্য আমরা।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া 2[জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
3[আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে ;]
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
সংবিধানের ৭৷ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে৷
(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷
নির্বাহী বিভাগের মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমান আদালত বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷
সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী বিভাগ দ্বারা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা অবৈধ ও বে-আইনী হলেও উচ্চ আদালতের মতামত অনুসারে সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে নির্বাহী বিভাগ উচ্চ আদালতের অনুমিত নিয়ে ভ্রাম্যমান আদলত পরিচালনা করছেন।
বর্তমানে অতিমারী করোনায় বিশ্ব থমকে আছে প্রায় দেড় বছর। বাংলাদেশও একই অবস্থায়। আমরা গরীব দেশ ও গরীব মানুষ। বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারী ঘরে অবস্থান করছেন। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ঘরে থাকায় মানষিক স্বাস্থ্যঝুকিতে ভুগছে। পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ক্ষুধার যন্ত্রনায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক আত্মহত্যাও করেছেন একাধিক।
এই অবস্থায় মানবিক দিক বিবেচনা করে জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য তৈরীর জন্য মহাবিপদে আমাদের পারস্পরিক মানবিক আচরণ অতীব জরুরী বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।