আজহারুল ইসলামকে হত্যা করার পর তার স্ত্রীকে কল দিয়ে ইমাম আব্দুর রহমান বলেছিল, ‘আমাদের সম্পর্কে আর কোনো বাধা নেই। ওরে শেষ করে দিছি।’ আসমা তখন পরামর্শ দিয়েছিল লাশ সাবধানে গুম করতে। যেন কোনোভাবেই কেউ টের না পায়। তারপর লাশটি ছয় টুকরো করে দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয় আব্দুর রহমান। ৫৪ বছর বয়সী ইমামকে পেতেই নিজ স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ২৫ বছরের আসমা আক্তার। শিশুপুত্রকে মসজিদে আনা-নেয়া করতে গিয়েই ইমাম আব্দুর রহমানের নজরে পড়ে আসমা। তারপর কৌশলে আজহারুল-আসমা দম্পতির ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এই ইমাম। আসমার স্বামী আজহারুলের অনুপস্থিতিতে বাসায় আসা-যাওয়া করতো ইমাম আব্দুর রহমান।
ইমামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গোপন মোবাইলফোন ব্যবহার করতো আসমা। আসমাকে ওই ফোন ও এক ছাত্রের নামে সংযোগ (সিম) কিনে দিয়েছিল ইমাম আব্দুর রহমান। প্রায়ই একান্তে সময় কাটাতো তারা। বিষয়টি খুব গোপনে ও কৌশলে ঘটলেও তা বেশিদিন গোপন থাকেনি। আজহারুলের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি তাদের পরকীয়া। বিষয়টি জানার পরই শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ। এর জের ধরেই পরিকল্পিতভাবে আজহারুলকে হত্যা করে ইমাম আব্দুর রহমান। রাজধানীর দক্ষিণখানের চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ইমাম আব্দুর রহমান ও তার প্রেমিকা আসমা। সরদারবাড়ি জামে মসজিদের এই ইমামকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিল আসমা। সেই পথের বাধা দূর করতেই দুনিয়া থেকে আজহারুলকে সরিয়ে দিতে পরিকল্পনা করে তারা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রামের বাড়িতে থাকা আজহারুলকে ঢাকায় পাঠায় আসমা। তারপরই ঘটে হত্যাকাণ্ড।
গ্রেপ্তারের পর আব্দুর রহমান ও আসমাকে গতকাল আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অনুজ কুমার সরকার। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাকিম বেগম নিভানা খায়ের জেসি তাদের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তার আগে মঙ্গলবার সকালে দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে আজহারুলের ছয় টুকরা লাশ উদ্ধার ও ইমাম আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বিকালে আব্দুল্লাহপুর থেকে আসমাকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে র?্যাব-১। এরপরই আসমা র?্যাবের কাছে পরকীয়া সম্পর্ক ও হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে নিহতের ছোট ভাই মোহাম্মদ হাসান বাদী হয়ে আসমা বেগম ও সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর আসমা নিজেকে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে স্বীকার করে। তার নির্দেশে ইমাম পরিকল্পিতভাবে তার স্বামী আজহারুল ইসলামকে হত্যা করে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ইমামের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে যায় আসমা। চার বছর বয়সী সন্তানকে মসজিদের মক্তবে আনা- নেয়া করতে গিয়ে ইমাম আব্দুর রহমানের নজরে পড়ে এই নারী। সেখান থেকেই শুরু। স্বামী ও শিশু সন্তানকে কোরআন শিক্ষা দেয়ার নামে কৌশলে ইমামকে বাসায় আসার সুযোগ করে দেয় আসমা। এতে সহজেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তারা। আজহারুলের অনুপস্থিতিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই বাসায় সময় কাটাতো ইমাম আব্দুর রহমান। বিষয়টি টের পেয়ে যান আসমার স্বামী গার্মেন্টকর্মী আজহারুল। এরপরই আজহার বাসা পরিবর্তন করে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকার হাজী মার্কেটের সামনে চলে যান। এতেও চিড় ধরেনি আসমা-ইমামের সম্পর্কে। নিয়মিত দেখা হতো তাদের। যোগাযোগের জন্য গোপন মোবাইলফোন ব্যবহার করতো এই প্রেমিক জুটি। আজহারুল গার্মেন্টসে কাজ করতে চলে গেলে দিনভর ফোনে ইমামের সঙ্গে কথা বলতো এই নারী। এ বিষয়টি শিশু সন্তান আরিয়ানের মাধ্যমে জানতে পারে আজহারুল। এমনকি গত মার্চ মাসে ইমাম আব্দুর রহমান ও আসমাকে নিজ বাসায় অন্তরঙ্গভাবে দেখতে পায় আজহারুল। এতে আজহারুল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সেদিন ইমাম দ্রুত ওই বাসা ত্যাগ করে। এ নিয়ে আসমা ও আজহারুলের মধ্যে ঝগড়া হয়। দূরত্ব তৈরি হয়। গত ২৬শে এপ্রিল আজহারুল অসুস্থ হয়ে গেলে কলেরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে স্ত্রী আসমা ও সন্তান আরিয়ানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে চলে যান আজহারুল। নিহত আজহারুলের ভাই হাসান জানান, বাড়িতে যাওয়ার পর আসমার সঙ্গে ইমাম আব্দুর রহমানের পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের জানান আজহারুল। বিষয়টি জানার পর সপরিবারে ঢাকায় আসতে নিষেধ করা হয় আজহারুলকে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঈদ পরবর্তীতে ১৯শে মে আজহারুল তার স্ত্রী ও সন্তানকে টাঙ্গাইলের বাড়িতে রেখে ঢাকায় আসেন। এসময় আজহারুলের কাছে টাকা ছিল না। আসমা ৫শ’ টাকা দিয়ে তাকে ঢাকায় পাঠায়। ঢাকায় পৌঁছে সারাদিন গার্মেন্টসে ডিউটি করে সন্ধ্যার পর আজহারুল চলে যান সরদার বাড়ি জামে মসজিদে ইমামের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ইমাম তাকে নিজ কক্ষে ডাকে। সেখানে স্ত্রী আসমার সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টি নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে কক্ষে রাখা গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে আজহারুলের শরীরে দুটি আঘাত করে ইমাম আব্দুর রহমান। আজহারুল ওই কক্ষ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে ইমাম গলায় উপর্যুপরি কোপ দেয়। এতেই আজহারুল মারা যান। পরে রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইমাম পর্যায়ক্রমে আজহারুলের লাশ ছুরি ও চাপাতি দিয়ে ছয় টুকরা করে। ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগেই ইমাম প্রতিটি টুকরা মসজিদের নিচতলায় সিঁড়ির নিচে সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়। নিজের কক্ষের এবং সেপটিক ট্যাঙ্কের আশপাশের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে। এরপর ঢাকনার ওপর দুটি সিমেন্টের বস্তা রেখে দেয়। দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক জানান, এই ঘটনায় আসমা ও আব্দুর রহমানকে পৃথক পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এই হত্যা মামলার গ্রেপ্তার মাওলানা আব্দুর রহমান (৫৪) গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানার শ্রীরামকান্দি গ্রামের মৃত লুৎফর রহমানের পুত্র। অপর আসামি আসমা আক্তার (২৫) টাঙ্গাইল জেলা সদরের কুইজবাড়ির আশরাফ আলীর মেয়ে ও নিহত আজহারুল ইসলামের স্ত্রী। জানা গেছে, আজহারুলকে বিয়ে করার আগে ২০১৫ সালে তার বড় ভাই শাহাবুদ্দিনকে বিয়ে করে আসমা। পরবর্তীতে দেবর আজহারুলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে পালিয়ে ঢাকায় এসে তাকে বিয়ে করে। ২০১৭ সালে এই দম্পতির আরিয়ান নামে এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়।