গেল বছর করোনাকালের শুরুতে বাংলাদেশ-ভারত প্রতিবেশী দেশ দুটোর সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ভারতের গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছিল, কয়েক মাস ধরে বার বার চেষ্টা চালিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি ভারতের (তৎকালীন) হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ। এমন কি করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঢাকা কোনো নোট পর্যন্ত পাঠায়নি! কিন্তু জুলাইয়ের শেষের দিকে সচিবালয়ে ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিকতর উষ্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং উন্নয়নমুখী। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ’৭১ এর রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। দুই দেশের সম্পর্কের সেতুবন্ধন সময়ের পরিক্রমায় দিন-দিন নবতর মাত্রায় উন্নীত হচ্ছে।’ এর কিছুদিন পর আগস্টের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। আর চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক।’ তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, আরেকটু যোগ করে এ বছরের একেবারে শুরুতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের। এই সম্পর্ক অর্থেরও। ব্যবসাই ভারত ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
ব্যবসা মানে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন।’
বিক্রমের বক্তব্যের কয়েকদিন পরই ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আসে বাংলাদেশে। এরপর ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারিতে ৫০ লাখ পেলেও ফেব্রুয়ারিতে পায় মাত্র ২০ লাখ। কারণ ইতিমধ্যেই ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে স্থগিতাদেশ দেয়। এরপর আর কোনো টিকা পায়নি বাংলাদেশ। ভারতের করোনার যা অবস্থা তাতে অদূর ভবিষ্যতে তা আর পাওয়ার সুযোগও নেই। মাঝখানে অবশ্য নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে মার্চে আরো ১২ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মিডিয়া তখন ইঙ্গিত করেছিল, ঢাকায় চীনের উপস্থিতি কমাতেই নরেন্দ্র মোদি ছুটে গেছেন।
বাংলাদেশই ছিল প্রথম প্রতিবেশী দেশ, যাদের সঙ্গে ভ্যাকসিন দেয়ার চুক্তি হয়েছিল ভারতের। তখন অনেকে বলেছিলেন, এতে বাংলাদেশকে যে ভারত কতটা গুরুত্ব দেয়, তা পরিষ্কার হলো। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে চাইলেও বাংলাদেশকে আর ভ্যাকসিন দিতে পারছে না ভারত। এদিকে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেয়া অনেক বাংলাদেশিকে কবে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে তা নিয়েও শুরু হয় অনিশ্চয়তা। ফলে শুরুতে অনেকের দেয়া ‘বিকল্প উৎস থেকেও টিকা সংগ্রহ’ করার পরামর্শ উপেক্ষা করা সরকার এক প্রকার বাধ্য হয়েই চীন, রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও তাদের উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিন চাওয়া হয়।
এপ্রিলের শেষের দিকে দেশে চীনের ভ্যাকসিন সিনোফার্মের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। বলা হয়, প্রথমে চীন ৫ লাখ ডোজ অনুদান হিসেবে দেবে। কিন্তু কবে এই ভ্যাকসিন দেশে পৌঁছবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝেই গতকাল ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানান, সিনোফার্মের তৈরি পাঁচ লাখ ভ্যাকসিন আগামীকালই (১২ই মে) বাংলাদেশে আসছে।
এই উপহারের জন্য বাংলাদেশকে ৩রা ফেব্রুয়ারি প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশের অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ তিন মাস তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশ অনুমতি দিলে চীনের ভ্যাকসিন আগেই পেতো। চীনের ভ্যাকসিনের চাহিদা অনেক দেশের আছে।
তাই বাণিজ্যিকভাবে যেটা বাংলাদেশ পেতে চায়, সেই ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশের সময় লাগবে।’
এপ্রিলের শেষে যখন দেশে চীনা ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয় ওই সময়েই চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি ঢাকা সফর করেন। তার সফরের ঠিক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, জরুরি প্রয়োজনে ভ্যাকসিন পেতে চীনের উদ্যোগে নতুন প্ল্যাটফরমে যুক্ত হতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ যাতে মোটামুটি ছয়টি দেশ সম্মত হয়েছে। অন্য চারটি দেশ হলো আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। অবশ্য চীনের উদ্যোগে এই ছয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে এর আগেও কয়েকটি বৈঠক হয়েছে বলে চীনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশ চীনের উদ্যোগে নতুন প্ল্যাটফরমে যুক্ত হচ্ছে মোমেনের ওই বক্তব্যের দিনই ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম জানান, করোনার ভ্যাকসিনের সংকট থাকলেও বাংলাদেশ যেন ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, ভারতের পক্ষ থেকে সেই সহযোগিতা করা হবে। বিক্রমের বক্তব্যের পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ভারত অবশ্য নতুন কিছু জানাতে পারেনি।
ওদিকে এপ্রিলের শুরুতে ভারতের সেনাপ্রধানের ঢাকায় এক দীর্ঘ সফরের পর একই মাসে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর ঘিরে নানা জল্পনা শুরু হয়। ঢাকার গণমাধ্যমের খবর- রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারতসহ চারটি দেশের কৌশলগত অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াড নিয়ে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাদের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাইরের শক্তির এমন ‘সামরিক জোটের’ বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায় চীন। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে কোয়াড যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়েও বেইজিংয়ের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো না হলেও চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া ঢাকা থেকে ‘বাংলাদেশ, চীন সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে যাতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের কোনো শক্তির সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা এবং আধিপত্য বিস্তার রুখতে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে দুই পক্ষের যৌথ প্রয়াস চালানো উচিত। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অবশ্য বলেন, দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদান থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হলেও কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তার বিষয়টি থাকলে তাতে যুক্ত হবে না।
বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা অনেকটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত অনেককে অবাক করে দিয়ে খোলামেলাভাবে জানিয়ে দেন- কোয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে। এ বিষয়ে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরকালীন তার অনুরোধের জবাবে বাংলাদেশ কী বলেছে জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত তা এড়িয়ে যান। বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘চীন সবসময় মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়াড হচ্ছে চীনবিরোধী একটি ছোট গ্রুপ। অর্থনৈতিক প্রস্তাবের কথা বললেও এতে নিরাপত্তার উপাদান আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাপানও এখানে চীনের বিরুদ্ধে বলছে। এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়ার ভাবনাটা ভালো না। বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে।’
সম্প্রতি নেপালের কাঠমান্ডু পোস্টে লেখা এক কলামে মেজর জেনারেল (অব.) বিনোজ বাসনিয়াত লিখেছেন, ভারত যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন চীন কৌশলগত সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ঠিক করে নিচ্ছে। চীন যখন কেন্দ্রে অবস্থান করছে তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কোন্ দিকে যাবে। সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকবে, নাকি গণতন্ত্রের দিকে। জোট-নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখবে নাকি সব জোটেই নিজেকে যুক্ত করবে।
তিনিও ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে লিখেছেন, চীন মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ন্যাটোর মতো আরেকটি সামরিক জোটের সূচনা করছে। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই অঞ্চলে বাইরের শক্তির বিরোধিতা করার জন্য শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। ইন্দো-প্যাসিফিকের হিমালয় অঞ্চলে উদীয়মান কোয়াড জোট এবং চীনের মহামারি কূটনীতির বিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাবের ক্ষেত্রে এক ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা বলে বিনোজ মনে করেন।
২০১৭ সালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সম্মেলনে ভারত যোগ না দিলেও দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ: বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। এর ঠিক আগের বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফরের পর জানানো হয় চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেবে বিভিন্ন খাতে। এদিকে ২০২০ সালে করোনা বিপর্যয়ের বছর শুরু করেও শেষ তিন মাসে চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনের অর্থনীতি রেকর্ড ১৮.৩ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৯২ সালে চীন জিডিপি’র হিসাব রাখা শুরু করার পর এটাই সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির রেকর্ড। অন্যদিকে নতুন করে করোনায় জর্জরিত ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমঅবনতির দিকে যাবে বলে ধারণা সকল বিশ্লেষকদের। তাছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র চীন থেকে আসছে। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর বহরে যুক্ত দুটি সাবমেরিনও চীনের তৈরি। বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তারাও অনেকেই চীন থেকে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। সেদিক থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হলেও সেটা অনেকটাই রাজনৈতিক সম্পর্ক, সামরিক নয় বলে অনেকের মত। এক কথায় ভ্যাকসিন, অর্থনীতি, সামরিক এসব ইস্যু মাথায় রেখে বাংলাদেশ এখন কোন্ পথে হাঁটবে? কঠিন এক সিদ্ধান্ত। একদিকে অর্থনীতি। অন্যদিকে বন্ধুত্ব।