‘মে দিবস’ কৃষিশ্রমিকের কাছে শুধুই ক্যালেন্ডারে লাল সংখ্যা

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


গ্রীষ্মের প্রচ- উষ্ণতায় মানুষ থেকে প্রাণী সবাই খোঁজে প্রশান্তির ছায়া। পাখিরা আশ্রয় নেয় গাছের মগডালে পত্র-পল্লবের ছায়ায়। বনের রাজা সিংহ কিংবা বাঘ সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও গরম থেকে বাঁচতে নেমে পড়ে পানিতে। গরমের কাছে সবাই যখন কাবু, তখনো একজন কৃষক বা কৃষিশ্রমিক ব্যস্ত থাকেন কৃষিকাজে। এ মানুষগুলো গরমকে উপেক্ষা করে তাদের কর্মে থাকেন অবিচল। শীতের চিত্র আবার ভিন্ন। কনকনে শীতের সকালে সবাই যখন কম্বল-কাঁথা মুড়ি দিয়ে উষ্ণতা খোঁজে, তখনো এ দেশের মেহনতি কৃষক কনকনে শীত উপেক্ষা করে ছুটে যান মাঠে ফসল ফলাতে। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন আজ সেই সব মেহনতি মানুষের প্রতীক মহান মে দিবস আমাদের সামনে উপস্থিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশ উন্নতি হলেও আমাদের কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কৃষকের ঘামঝরা পরিশ্রমে এ দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান আসে। কৃষকরা ঋণগ্রহণসহ নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে ফসল ফলান। বাম্পার ফলনের পরও কৃষকের লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই ওঠে না। অন্যদিকে কৃষকের ফসলের লাভের অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর দখলে। এর ওপর আছে বাজারদরের ব্যাপক ওঠানামা, পরিবহন জটিলতাসহ পণ্য স্থানান্তরে কালক্ষেপণের দীর্ঘসূত্রতা, উৎপাদন পর্যায়ে নানা রকমের ঝুঁকি। এত সব অসঙ্গতির পরের দেশের কৃষকরা হরতাল করতে পারে না, তারা দুর্বল কণ্ঠ নিয়ে তাদের ন্যায্যমূল্য ও ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও করতে জানে না। বাংলাদেশে কৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের যথাযথ স্বীকৃতি নেই। শ্রম আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞায় কৃষিশ্রম অন্তর্ভুক্ত হলেও কৃষি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা নেই। ফলে এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।

মে দিবস বাংলাদেশের কৃষক এবং কৃষিজীবী মানুষের জন্য কী গুরুত্ব বহন করে- এমন প্রশ্নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান বলেন, মে দিবস সব শ্রমজীবী মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে বেশিরভাগ কৃষক হলেন প্রান্তিক পর্যায়ের। এসব কৃষকের দুটি রূপ রয়েছে। এরা কখনো উৎপাদন আবার কখনো কৃষিশ্রমিক। কৃষক কখনো নিজের জমিতে ফসল উৎপাদন করেন আবার কখনো অন্যের জমিতে কাজ করেন। কৃষক যখন কৃষিশ্রমিক, তখন তিনি মে দিবসের বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত। আর নিজের জমিতে কাজ করে তখন তার কর্মঘণ্টার কোনো ব্যাপার থাকে না।

গফরগাঁওয়ের কৃষক মো. জসিম মিয়াকে মে দিবস সম্পর্কে সম্পূর্ণ বুঝিয়ে বলার পর তিনি বলেন, ‘ক্ষেতে আমার পাকা ধান। ৮-৯ ঘণ্টা হিসাব করার সময় নেই। সময়মতো ধান কাটতে না পারলে সারাবছর খামু কী। মে দিবস আমার মতো কৃষকের কী কাজে আসবে। দিন-রাত কাজ করেই পেটের ভাত জোটে না, আবার ৮ ঘণ্টা! বৈশাখ মাসে তো ৮ ঘণ্টা ঘুমাইতেও পারি না। রাত ১২টা-১টায় ঘুমাই আর ৪টায় উঠি। তাই কাম (কাজ) কইরা কূলকিনারা পাই না। এসব দিবসটিবস হলো শহরের মানুষের জন্য। আমার এসব জেনে কোনো কাজ নাই।’

মে দিবস নিয়ে কথা হয় বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার একজন সফল কৃষক প্রদীপ রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষি খাত এগিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো সেভাবে নিশ্চিত হয়নি কৃষকের অধিকার। একজন কৃষক হিসেবে ‘মে দিবস’ আমার কাছে শুধুই ক্যালেন্ডারে লাল রঙের একটি সংখ্যা। যে সংখ্যার বিশেষ কিছু ভাবার নেই। আমি ইংরেজি মাসের হিসাব রাখি।

২০১৬-১৭ র্অথবছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৯২ লাখ রয়েছেন নারী শ্রমিক। এখানে কষ্টের বিষয় হলো, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কৃষি খাতে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। যেসব নারী দিনমজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করেন তারা প্রতিনিয়তই মজুরিবৈষম্যের শিকার হন। সেই সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের কাজে নিয়োজিত রাখা এবং অন্যান্য মানসিক নিপীড়ন। পুরুষদের দৈনিক মজুরি যেখানে ৪০০-৬০০ টাকা, নারীরা সেখানে পান মাত্র ৩০০-৩৫০ টাকা। এখানে নারীদের স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা নিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *