শ্রমিকের কাছে ভাতের চিন্তা সবার আগে

Slider সারাদেশ

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের শেষ উপায় হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। অফিস-আদালত, কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে বসে থাকা। বাংলাদেশেও গতবছর লকডাউনের আদলে সবকিছু বন্ধ রাখা হয়েছিল দুই মাসের বেশি সময়। এ বছর হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে গেলে গত ৫ এপ্রিল থেকে চলছে চলাচলে কড়া বিধিনিষেধ তথা অঘোষিত ‘লকডাউন’।

এ লকডাউন কারও কারও জন্য স্বস্তি বয়ে আনলেও গরিব মানুষের কাছে তা হয়ে ওঠে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। দিন আনে দিন খাওয়া মানুষের কাছে সবকিছুর আগে ভাতের চিন্তা। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাজার নিয়ে ঘরে ফেরা মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই সংগ্রামের। হাত গুটিয়ে বসে রোগ-শোকের কথা ভাবার সময় তার নেই। রাজধানীজুড়ে এমন অসংখ্য মানুষের দেখা মেলে যারা কিছুদিন আগেও কাজ করে খেতেন, তারা এখন শহরের ফুটপাতে বসে থাকেন সাহায্যের আশায়। খিদের যন্ত্রণাই তাদের লকডাউনের মধ্যেও রাস্তায় নামিয়ে আনে।

রাজধানীর মাতুয়াইল সাদ্দাম মার্কেট এলাকায় রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করেন মিজানুর রহমান। জীবিকার তাগিদে এ এলাকায় ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া করে ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন তিনি। পরিবার থাকে কিশোরগঞ্জে। কথা হলে জানা যায়, ভালো নেই মিজানুর। চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন তিনি। বললেন, আয়-রোজগার নাই, উল্টা বেকার বইসা থাইকা দেনার বোঝা ভারী হইতাছে ভাই। মিজান বলেন, দৈনিক চুক্তিতে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করি। কাজ বন্ধ থাকলে আয়ও বন্ধ থাকে। লকডাউনের প্রথমদিকে বিল্ডিং বানানোর কাজ চালু থাকলেও বর্তমানে তা একেবারেই বন্ধ। এখন ওস্তাদেও ডাকে না, টাকা-পয়সাও পাই না। গ্রামে যে চইলা যাব তাও পারতেছি না। পরিবারকে এক টাকাও পাঠাইতে পারতেছি না। উল্টা এইখানে ধার করতে হইতাছে। হতাশাভরা কণ্ঠে মিজান শেষ করেন- লকডাউন আমাদের মরার রাস্তা। ঘরে থাকলে না খেয়ে মরব। করোনায় মরার থেকে না খেয়ে মরা অনেক কষ্টের।

রাজধানীর ‘অনাবিল সুপার’ বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ করেন নাসিম হাসান। ট্রিপ হিসেবে বেতন পাওয়া এই পরিবহন শ্রমিক বলেন, আমাগো জীবন বাসের চাক্কার লগে ঘোরে। চাক্কা বন্ধ তো আমাগো জীবনও বন্ধ। কতগুলা দিন হইলো, বাস চলে না। বাসের অভাবে রাস্তায় মানুষ দুর্ভোগ পোহাইতাছে আর আমরাও অভাবে দিন কাটাইতাছি। দেনা কইরা আর কয়দিন চলা যায়। শিগগিরই বাস চালু না হইলে বউ-বাচ্চা নিয়া ভিক্ষা করতে হইব।

কেবল মিজান বা নাসিম নন, করোনাকালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকা। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী রাসেল হোসেন। করোনা তার জীবিকার ধরনই বদলে দিয়েছে। রাসেল জানান, আগে মাসিক বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। এখন দৈনিক চুক্তিতে কাজ করতে হচ্ছে। এতে আয় যেমন কমেছে, বেড়েছে জীবিকার অনিশ্চয়তা। রাসেল বলেন, বারবার লকডাউন আর কদিন পরপর মার্কেট খোলা-বন্ধ হওয়ায় মালিক এখন আর মাস হিসেবে বেতন দিতাছে না। মালিক বলতাছে, ব্যবসায় লোকসান। দোকান বন্ধ রাইখা গোটা মাসের বেতন দেওয়া সম্ভব না। তাই যে কদিন দোকান খোলা হবে, সে কদিনের বেতন দেওয়া হবে।

রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁ-বেকারি কর্মচারীদেরও একই দশা। করোনার লোকসানের কারণে অসংখ্য শ্রমিক ও কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়ন।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা হলে কেবল তৈরি পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কথা হয়। দেশে মনে হয় আর কোনো শ্রমিক নেই। করোনায় হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, বেকারিতে যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ও কর্মচারীরা কষ্টে আছে তা কেউ দেখে না। আমরা এসব শ্রমিকের জন্য প্রণোদনাসহ পূর্ণ রেশনিং চালুর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।

করোনার প্রথম ধাক্কায় সঞ্চয় হারিয়েছেন অনেকে। এ সময় যৎসামান্য সঞ্চিত অর্থ, অলঙ্কার কিংবা পালিত পশু বিক্রি করে কোনো রকমে কেটেছে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন। এর পর দেনায় জড়িয়েছেন অনেকেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ জীবিকার জন্য দৈনন্দিন কর্মনির্ভর। তাই দেশের অর্থনীতির দিকটিও গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে দেশকে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত ‘পভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউসহোল্ড রিয়েলিটিস’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা গেছে, কোভিড ১৯-এর আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গত বছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনো ফেরেনি। প্রাক-কোভিড সময়ের তুলনায় শহরের বস্তিবাসীর আয় কমলেও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় গত জুনের তুলনায় এ বছরের মার্চে দ্বিগুণ হয়েছে। সবার সঞ্চয় কমেছে ব্যাপকভাবে। ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব নিয়ে পরিচালিত আর এক জরিপে সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোরাম (সানেম) জানায়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে এটি ছিল ২১.৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা করোনাকালে ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ২৩ শতাংশ বেতনভিত্তিক কর্মচারী ও ২৯ শতাংশ দিনমজুর।

বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, চলমান ‘লকডাউনের’ ঘোষণায় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কথা ভাবা হয়নি। ক্ষুধা যে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর সেই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। খাদ্যের জোগান দিতে না পারলে গরিব মানুষকে যে ঘরে রাখা যাবে না, তা ভাবা হয়নি। ঘোষণায় সামগ্রিক পরিকল্পনার ছাপ দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউন ঘোষণা করলেই তো আর বিপদ কেটে যায় না। হয়তো করোনার সংক্রমণ কমবে।

কিন্তু এতে অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের জীবনধারণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কারণ দেশে খেটে খাওয়া মানুষ তথা শ্রমজীবীর সংখ্যাই বেশি। সন্তান যখন অনাহারে কাঁদে তখন বাবার কাছে খাবার জোগাড় করাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই কড়াকড়ি লকডাউনের আগে এসব পরিবার কীভাবে খেয়ে পরে বাঁচবে তা ঠিক করার দরকার ছিল। তিনি আরও বলেন, যে কদিনের লকডাউন দিলে সত্যিকার অর্থেই তা করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় কার্যকর হবে, ততদিন পর্যন্ত লকডাউন দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলে অল্প দিনের লকডাউন দিয়ে জীবনেরও তেমন লাভ হবে না, জীবিকাও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তখন করোনার সঙ্গে সঙ্গে অভাবে পড়ে মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *