নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে আলোচনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (এইচইডি)। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল না মানা, প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ প্রাক্কলন ব্যয় এবং নিম্নমানের স্থাপনা নির্মাণের মতো অনিয়মের অভিযোগ আসছে অহরহ।
এ ঘটনা নিয়মিত ঘটছে সংস্থাটিতে। এতে করে একদিকে সরকারের শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। অন্যদিকে দেশব্যাপী নির্মিত স্বাস্থ্য স্থাপনাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। এসব অনিয়ম তদন্তে মাঝেমধ্যে তদন্ত কমিটি হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। উপরন্তু দোষীদের পুরস্কৃত করে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্রে অনিয়মের নানা চিত্র ধরা পড়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিট নির্মাণের কিছুদিন পর ভবনটি একদিকে হেলে পড়ে। তদন্তে ধরা পড়ে, ঐ ভবনটির নকশা অনুযায়ী ভিত্তিতে ৭০ ফুট লম্বা পাইল করার কথা থাকলেও করা হয়েছে মাত্র ৩০ ফুট। যে ভবনটির ভিত্তি ছয়তলার ওজন বহন করার কথা সেটা দুই তলার ওজনেই হেলে পড়েছে। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটি নির্মাণের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনটির নির্মাণকাজ চলাকালীন নিবিড় তদারকির দায়িত্বে থাকা তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার সহকারী প্রকৌশলী বর্তমানে এইচইডি প্রধান কার্যালয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। মিরপুরের লালকুঠির মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণকাজটি বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ১৪ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদার মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ করার পর তাকে প্রায় ১৩ কোটি টাকার ভুয়া বিল দিয়ে ভাগাভাগি করা হয়। কিছুদিন পূর্বে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনরায় ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজটি করা হয়েছে। এতে সরকারের ১৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। খুলনা আইএইচটি এবং নার্সিং কলেজ নির্মাণ কাজে ইতিপূর্বে প্রায় ১৩ কোটি এবং ১০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিছু কাজ করার পর ঠিকাদারকে ৯০ ভাগ টাকার বিল দিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। ছয়মাস আগে ঐ আইএসটি’র অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে প্রায় ২৪ কোটি টাকা এবং নার্সিং কলেজের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে প্রায় ১৭ কোটি টাকার প্রাক্কলন করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৪০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। অনুরূপ ভাবে গত কয়েক বছরে দেশে আরো প্রায় ৫০টির অধিক স্বাস্থ্য স্থাপনা নির্মাণ কাজে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভাগাভাগির কারণে সরকারের শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। মহাখালীর স্বাস্থ্য ভবন নির্মাণ কাজে প্রথম পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ঠিকাদারকে ভুয়া বিল দিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা ভাগাভাগি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে চার তলা ভবন নির্মাণে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা কার্যাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু ভবনটির কলাম, বিম ও ছাদ ঢালাই করে ভুয়া পরিমাপ দিয়ে সমুদয় টাকা ব্যয় করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তে কোটি কোটি টাকা ভুয়া বিল প্রদানের বিষয়টি ধরা পড়ে। অভিযোগ আছে, মাঠ পর্যায়ে যে সব প্রকৌশলী এসব পুকুর চুরি করেছিলেন তার দায় তাদের ওপর চাপানো হয়নি। উল্টো তাদেরকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে।
এইচইডি মূলত ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ শয্যা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ হতে ৫০ শয্যা উন্নীতকরণ করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনতলা বিশিষ্ট ১০ শয্যার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর প্রতিটির আয়তন প্রায় ১০ হাজর ৭০০ বর্গফুট। এইচইডি এগুলোর কাঠামো ইটের খোয়া দিয়ে করছে এবং প্রতিটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরেছে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এতে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকারও বেশি। অন্যদিকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) ইউনিয়ন পর্যায়ে চারতলা স্কুল-মাদ্রাসা নির্মাণ করছে। স্কুল-মাদ্রাসা ভবনগুলোর প্রতিটির আয়তন প্রায় ১৪ হাজার ৩৩০ বর্গফুট। কাঠামো ইটের খোয়া দিয়ে করা নির্মিত প্রতিটির প্রাক্কলিত ব্যয় ইইডি ধরেছে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এতে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ২৮২ টাকা। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে এইচইডি ৩১ হতে ৫০ শয্যার উন্নীত করছে। পাথরের খোয়া দিয়ে প্রায় ৩২ হাজার বর্গফুটের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণে এইচইডি প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় ১৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এতে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। ইইডি উপজেলা পর্যায়ে ২৯ হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের কলেজ ভবন নির্মাণ করছে। পাথরের খোয়া দিয়ে যার প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকা। এতে প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৩৪২ টাকা। অথচ এইচইডি ও ইইডি গণপূর্তের একই দর অনুসরণ করেছে এবং তারা একই উপকরণ ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করছে। বাস্তবে এইচইডি প্রাক্কলনে ৪০ হতে ৫০ ভাগ ভুয়া পরিমাপ থাকে বিধায় তাদের প্রাক্কলিত ব্যয় বেশি হয়।
এইচইডিতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। যেকোনো নির্মাণ কাজে দুর্নীতি বন্ধ করার প্রথম ধাপ হলো ঐ কাজের প্রতিটি আইটেমের কাজের পরিমাপ সঠিকভাবে পরিমাপ করা এবং কাজের পরিমাণকে দর দিয়ে গুণ করে সঠিক প্রাক্কলন করা। কিন্তু এইচইডি’তে ভবন নির্মাণে বিভিন্ন আইটেমের কাজের পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। এইচইডি’র প্রধান প্রকৌশলী নিজেই দরপত্র আহ্বান করে পছন্দের ঠিকাদারকে গোপনে প্রাক্কলিত মূল্য জানিয়ে দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার সুযোগ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পিপিআর লঙ্ঘন করে নিজেই অনুমোদন দেন, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করে কার্যাদেশ প্রদান করেন এবং ঠিকাদারদের বিলও তিনি পরিশোধ করেন। এ প্রক্রিয়ায় হাতেগোনা কয়েকজন অনভিজ্ঞ ও অপেশাদার ঠিকাদার নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন অধিদপ্তরে-এমন আলোচনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে তারা প্রায় ১০ শতাংশ টাকা দিয়ে কাজ নিয়েছেন। এভাবে পদে পদে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন লঙ্ঘন করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
এইচইডি’র একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ঠিকাদার ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়নের সময় মাঠ প্রকৌশলীদেরকে কোনো তোয়াক্কা করেন না। তারা হুমকি-ধামকি দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেন। তারা কাজ বাস্তবায়নের সময় প্রধান কার্যালয় হতে এক রকম নকশা এবং বিলের সময় অন্য রকম নকশা নিয়ে আসেন। কাজ বাস্তবায়নের নকশায় অনেক কম রড দেখানো থাকে কিন্তু বিলের নকশায় অনেক বেশি রড ধরা থাকে। কাজ বাস্তবায়নের সময়ে স্বাস্থ্য স্থাপনাগুলোর ভিত্তিতে সাধারণ ফুটিংয়ের নকশা দেয়া হলেও বিল করার সময় পাইলের নকশা দেয়া হয়। কোথাও পাইল করা হলেও নকশার চেয়ে পাইলের সংখ্যা এবং পাইলের দৈর্ঘ্য অনেক কম দেয়া হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে ঠিকাদাররা তাকে হয়রানিমূলক বদলি করান। কাজ না করেও ঠিকাদারকে বিল দেয়ার জন্য প্রধান কার্যালয় হতে চাপ দেয়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক বিল না দিলে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়। দেশের অন্যান্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীরা কোনো প্রকার দরপত্র আহ্বান কিংবা ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করেন না। অন্যান্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং সহকারী প্রকৌশলী বিল প্রস্তুত ও স্বাক্ষরের পর বিভাগীয় পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করেন। মাত্র তিনজনের স্বাক্ষরে ঠিকাদাররা বিল পান। এইচইডিতে ৩০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী থাকলেও তাদেরকে বিল পরিশোধ করতে দেয়া হয় না। প্রধান প্রকৌশলী নিজেই ঢাকায় বসে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করছেন। এ জন্য ঠিকাদারের বিল সহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয় হতে বিভাগীয় এবং সার্কেল কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রধান কার্যালয়ে যায়। প্রধান কার্যালয়ের এস্টিমেটর হতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত প্রায় ১৫ জন কর্মকর্তার স্বাক্ষরের পর প্রধান প্রকৌশলী বিল পাস করেন। এত ঘাট পার করতে ঠিকাদারদের আরো ১০ শতাংশ টাকা ব্যয় হয়। এই বাড়তি টাকা যোগান দিতে ঠিকাদাররা নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং মোটা রডের পরিবর্তে চিকন রড, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সিমেন্ট ব্যবহার করে। এভাবে নির্মিত হাসপাতালগুলোর কাজের মান খুবই নিম্নমানের হচ্ছে। এতে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পে এই স্থাপনাগুলো ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সাইদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দর প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে গণপূর্তের দরই অনুসরণ করে। বাড়তি উপকরণের বিষয়ে তার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি বলে জানান তিনি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল ভঙ্গের বিষয়ে তিনি বলেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল ভঙ্গের সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা নজরে আসলে অবশ্যই তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।