বাড়ি ভাড়া দিতে ও খেয়ে বাঁচতে মধ্যবিত্তরা ঘরের স্বর্ণ বিক্রি করছেন!

টপ নিউজ

ঢাকা:করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে হু হু করে বেড়েছে স্বর্ণের দাম। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। যদিও দাম এখন সামান্য কমেছে। করোনার শুরুর দিকে মার্চ মাসে হঠাৎ করে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার টাকায়। এটা ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম। অবশ্য গত বৃহস্পতিবার ২ হাজার ৪৪৯ টাকা কমেছে। বর্তমানে প্রতি ভরির দাম হচ্ছে ৭৪ হাজার টাকার উপরে।

একদিকে করোনার ছোবল অন্যদিকে স্বর্ণের আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে স্বর্ণ কেনার সাহস নেই সাধারণ মানুষের। বরং সংসারের ব্যয় নির্বাহে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বিক্রি করছেন অনেকেই। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে গহনা বিক্রি করতে স্বর্ণের দোকানেও ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররমসহ বড় বড় মার্কেটগুলোর দোকানে ক্রেতাদের থেকে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত বাংলাদেশের বাজারে স্বর্ণের ভরি কী দামে বিক্রি হবে, তা নির্ধারণ করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। বিশ্ববাজারে দাম বাড়া-কমার ওপর ভিত্তি করে এই দাম নির্ধারণ করে সংগঠনটি। বিশ্ববাজারের ৭ দিনের দামের গড় ভিত্তিতে কী পরিমাণ দাম বাড়বে না কমবে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বাজুস এর তথ্য মতে, গেল জুলাই-আগস্ট মাসে ২০ হাজার পরিবার বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করেছে। আর্থিক সংকট মেটানোর পাশাপাশি অনেকেই বাড়তি দামের আশায় স্বর্ণ বিক্রিতে ঝুঁকছেন। এর আগে গ্রাহকের বিক্রি করে দেয়া এতো পরিমাণ স্বর্ণ তাদের কেনার রেকর্ড নেই বলেও জানিয়েছেন বিক্রেতারা। গেল বছরের তুলনায় ক্রেতাদের স্বর্ণ বিক্রি বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। গ্রাহকেরা গলার হার ও কানের দুল থেকে শুরু করে হালকা-ভারী সবধরনের গহনাই বিক্রি করছেন। বিপরীতে স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ক্রেতা কমেছে কমপক্ষে ৮০ ভাগ।
বাজুস সভাপতি এনামুল হক বলেন, মানুষ প্রয়োজনেই হোক আর অপ্রয়োজনেই হোক ব্যাপকহারে স্বর্ণ বিক্রি করে দিচ্ছেন। আমাদের শো-রুমগুলোতে আমরা যে পরিমাণ স্বর্ণ বিক্রি করছি, তার বিপরীতে ১০ গুণ স্বর্ণ আমাদের কাছে বিক্রি করার জন্য গ্রাহকেরা আসছে। করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক সংকট মেটাতে হোক কিংবা বেশি দামের আশায় হোক মানুষ স্বর্ণ বেচে দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
স্বর্ণের দাম কমানোর বিষয়ে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে স্বর্ণের মূল্য সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ফলে দেশীয় মার্কেটে স্বর্ণের মূল্য অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গত কয়েকদিনে বিশ্ববাজারে দাম কমেছে। এমন অবস্থায় বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে দেশের বাজারেও স্বর্ণের দাম কমানো হয়েছে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফাহিম আহমেদের মা সমপ্রতি নিজের কাছে গচ্ছিত কয়েক ভরি স্বর্ণ বিক্রি করেছেন। প্রায় এক যুগ আগে কেনা স্বর্ণগুলো বর্তমান বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন তিনি। বলেন, কম হলেও ভরিপ্রতি ২০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।

৩০ বছর আগে আসমা বেগমের বিয়ের সময় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে দু’টি হাতের বালা দিয়েছিল, সেই বালা দু’টি বিক্রি করতে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে এসেছেন তিনি। আসমা বেগম বলেন, করোনার পর থেকে স্বামীর ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। হাতে নগদ টাকা নেই। স্বামীর ব্যবসায় টাকা লাগবে- এ কারণে বালা দু’টি বিক্রি করে দিলাম। এখন স্বর্ণের দাম বেশি। এতে করে ভালো টাকাও পেয়েছি। যখন এ বালা দু’টি কিনেছিল- তখন এর দাম ছিল ৪ হাজার টাকা। এখন পঁচাত্তর হাজার টাকায় বিক্রি করলাম। বিয়ের স্মৃতি এজন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু কী আর করা! আবার যদি ভালো দিন আসে তাহলে বানাতে পারবো।

সাত্তার দম্পতি এসেছেন একটি চেইন বিক্রি করতে। সাত্তার একটি বায়িং হাউজে চাকরি করেন। বলেন, গত জুন মাস থেকে অর্ধেক বেতন পাচ্ছি। এদিকে বাড়ি ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছি। তারমধ্যে ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে হচ্ছে। হাতে কোনো টাকা নেই। তাই চেইনটা বিক্রি করে দিচ্ছি। এটা আমার স্ত্রীর চেইন। শখ করে বানিয়ে দিয়েছিলাম। প্রয়োজনের জন্য এখন কাজে লাগছে। তা না হলে ছেলেটাকে ভর্তি করাতে পারতাম না। এই করোনায় তো কারো অবস্থাই ভালো না। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে যে টাকা ধার নেবো সেটাও সম্ভব না। সবার তো একই অবস্থা। ১৯ বছর হলো আমাদের বিয়ের বয়স। কোনোদিন আমার স্ত্রীর গহনায় হাত দেইনি। এখন বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে।

বায়তুল মোকাররম মার্কেটের আমিন জুয়েলার্স-এর সেলস এক্সিকিউটিভ জয় জানান, তাদের স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে খুবই সীমিত। মানুষ স্বর্ণ কিনতে আসে না বললেই চলে। কিন্তু স্বর্ণ বিক্রি করতে আসে। জয় বলেন, নিম্নবিত্তরা তো স্বর্ণ কিনতেই পারে না। আর মধ্যবিত্তরা কেনে প্রয়োজনে শুধুমাত্র বিয়ে-শাদি হলে। শুধুমাত্র শখ করে স্বর্ণ কিনে থাকে উচ্চবিত্তরা। করোনায় তো উচ্চবিত্তরা হয় বিদেশে, না হয় ঘর থেকে বের হচ্ছে না। করোনার মধ্যে বিয়ে-শাদিও তেমন হচ্ছে না। দু’-চারটা যা হচ্ছে তাও গোপনে। আগে যেখানে পাঁচভরি স্বর্ণ দিতো এখন তা দুই ভরি দিয়ে সারছে। আমাদের স্বর্ণ বিক্রির অবস্থা খুব খারাপ। বিক্রি নেই বললেই চলে। বরং আমরা স্বর্ণ কিনছি। করোনায় মধ্যবিত্তরা পড়েছে বিপাকে। কারো চাকরি নেই। কেউ আবার বাড়ি ভাড়া দিতে পারছে না। এজন্য মধ্যবিত্তরা তাদের ঘরের স্বর্ণ বিক্রি করে দিচ্ছেন। করোনায় কয়েক দফা স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণে তারা ভালো দাম পাচ্ছে।

আফতাব জুয়েলার্স-এর সেলস এক্সিকিউটিভ জনক সাহা বলেন, ঘন ঘন দাম উঠানামার কারণে স্বর্ণের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। করোনার পর থেকেই স্বর্ণের বাজার স্থিতিশীল নেই। এটা শুধু আমাদের দেশে নয় আন্তর্জাতিক বাজারই অস্থির অবস্থায় আছে। এতে করে ক্রেতারা স্বর্ণের দোকানে আসছে না। তারা ভাবছে আরো দাম কমুক তারপর কিনবো। এখন সাধারণত কেউ ভারী গহনা কিনতে স্বর্ণের দোকানে আসে না। খুব বেশি হলে একটি আংটি বা নাকফুল ছাড়া কেউ অন্য কিছু কিনে না। করোনার সময় মধ্যবিত্ত পরিবারের কারো বিয়ে হলে এখন আংটি আর নাক ফুল দিয়ে বিয়ে হচ্ছে। যখন ৪৬ হাজার টাকা ভরি ছিল তখন মধ্যবিত্তরাও কমপক্ষে পাঁচ ভরির গহনা দিতো। তিনি বলেন, এখন তো মানুষের পকেটে পয়সা নেই। স্বর্ণ কিনবে কোত্থেকে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির হিসাবে ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে নিবন্ধিত স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। বাজুসের নেতারা বলছেন, এভাবে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকলে চলতি বছরের বাকি সময়ের মধ্যে প্রায় ২৫ ভাগ স্বর্ণের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *