ভারতের যে রাজ্যে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সবচেয়ে তীব্র আকার নিয়েছিল, সেই উত্তরপ্রদেশে সরকার অভিযুক্ত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ক্র্যাকডাউন শুরু করেছে।
মুজফফরনগর জেলায় ৫৩জন বিক্ষোভকারীকে ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোট ২৩ লক্ষ রুপি জরিমানা দিতে বলা হয়েছে, রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এমন একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
তারা বলছে, বিভিন্ন শহরে বহু দোকান সিল করে দেয়া হয়েছে, যার প্রায় সবই মুসলিমদের।
রাজ্যে প্রশাসনিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একদল ছাত্রছাত্রী দিল্লি অভিমুখে মিছিল করে আসছিলেন, গাজীপুরে তাদের মধ্যে থেকে জনাদশেককে কোনও পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দিযয়েছে।
মুজফফরনগরের প্রশাসন বলছে, গত ২০শে ডিসেম্বর সেখানে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছিল, সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিস্যুয়ালস দেখেই তারা প্রতিবাদকারীদের চিহ্নিত করেছেন – এবং তার ভিত্তিতেই মোট ৫৩জনকে নোটিশ পাঠিয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ লক্ষ রুপি ক্ষতিপূরণ জমা করতে বলা হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অমিত সিং জানাচ্ছেন, “সিভিল লাইন্স থানার আওতায় ৫৩জনকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, আর কোতোয়ালি থানার আওতায় অভিযুক্ত আরও ১৭জনের মামলা যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
আমরা এদের স্বত:প্রণোদিতভাবে টাকা জমা করতে বলেছি, কিন্তু তারা না-মানলে তহসিল অফিস থেকে আইনি নোটিশ পাঠানো হবে।
লখনৌ, কানপুর, মীরাট, সম্ভল, রামপুর, বিজনৌর ও বুলন্দশহর জেলাতেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে – এবং গোটা রাজ্যে ইতিমধ্যেই এরকম প্রায় শ’তিনেক প্রতিবাদকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তা ছাড়া বহু জায়গায় সন্দেহভাজন বিক্ষোভকারীদের দোকানপাটেও তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
মুজফফরনগরের মীনাক্ষি চকে এরকমই সার সার সিল করা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এলাকার এক বাসিন্দা বিবিসি সংবাদদাতাকে বলছিলেন, যে সব দোকান সিলগালা করা হয়েছে তার সবগুলোই কিন্তু মুসলিমদের।
পুলিশ ও প্রশাসন যখন এভাবে শাস্তি দিতে ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে ব্যস্ত, শহরের মুসলিম মহল্লার মহিলারা কিন্তু বিবিসিকে জানিয়েছেন সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরাই সে দিন তাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছে ও হুমকি দিয়েছে।
মদিনা চকের কাছে এক গৃহবধূ যেমন বলছিলেন, ওরা বাড়ির ভেতর ঢুকে ভাঙচুরই শুধু করেনি, সাড়ে তিন লাখ টাকার অলঙ্কারও লুঠ করে নিয়ে গেছে। দোতলায় উঠে আসবাব, ওয়াশিং মেশিন সব ভেঙেছে।
আমরা বাধা দিতে গেলে ধমক দিয়েছে, চুপ করো – জিনিস তো সব ভেঙেইছি, এবার এখান থেকেও তুলে দেব!
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এই সব নির্যাতন ও অত্যাচারের কথাই মানুষকে বলতে বলতে দিল্লি অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেছিল ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি দল, কিন্তু মাঝপথে গাজীপুরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাদের জনাদশেককে ধরে জেলে পুরেছে।
ওই পদযাত্রার আয়োজকদের একজন, থৃতি দাস বিবিসিকে বলছিলেন, গান্ধীর সত্যাগ্রহের পীঠস্থান চৌরিচৌরা থেকে শুরু করে তারা তার সমাধিস্থল রাজঘাট অবধি আসার পরিকল্পনা করেছিলেন – উত্তর প্রদেশের বুক চিরে।
চৌরিচৌরা থেকে আড়াইশো কিলোমিটার পথ হেঁটে গোরখপুর, কুশীনগর, আজমগড়া হয়ে তারা যখন গাজীপুরে পৌঁছান, তখনই ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে কোনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ তাদের আটক করে জেলে ভরে দেয়।
পরে যখন আইনজীবীরা তাদের জামিনের জন্য চেষ্টা করতে যান, তখন পঁচিশ লক্ষ রুপির বন্ড দিতে বলা হয় এবং অন্তত দুজন গেজেটেড অফিসারকে জামিনদার হিসেবে আনতে বলা হয়।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এধরনের কঠিন ও অসম্ভব শর্ত আরোপ করে উত্তরপ্রদেশ সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের রাস্তাটাই বন্ধ করে দিতে চাইছে, বলছিলেন থৃতি দাস।
গ্রেপ্তার হওয়া ওই ছাত্রছাত্রী ও অ্যাক্টিভিস্টরা জেলের ভেতরেই এদিন থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই ধরনের কঠোর দমন নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও, তবে গত সপ্তাহেই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি এ সব গায়ে মাখছেন না।
অভিযুক্ত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত যে হবেই, সে কথা জানিয়ে আদিত্যনাথ বলেন, বিক্ষোভের পদ্ধতি যদি গণতান্ত্রিক না-হয় এবং সাধারণ মানুষের অসুবিধা ঘটায় তাহলে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
মনে রাখতে হবে, সংবিধান কাউকেই প্রতিবাদ জানানোর সীমাহীন অধিকার দেয় না।
মুখ্যমন্ত্রী এর আগেই ঘোষণা করেছিলেন, তার সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বদলা নিয়েই ছাড়বে – এখন দেখা যাচ্ছে তার পুলিশ ও প্রশাসন সেই প্রতিশোধ কর্মসূচিরই বাস্তবায়ন শুরু করেছে পুরোদমে।।