চারদিকে শুধুই খবর, খবরের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। খবরের কাগজ খুলতেই, টেলিভিশন অন করতেই, অনলাইনে ক্লিক করতেই খবর। খবর। খবর। খবর। কিন্তু এই খবর কীসের? এই খবর কাদের? খবর, যাদের টাকা আছে তাদের। যে বাণিজ্যিক রাজনীতি চলছে তার। যে রাজনীতিতে অনেক টাকার খেলা, আদর্শ যেখানে সস্তা খেলনা, জনমানুষের কথা যেখানে নেই, ক্ষমতাই একমাত্র উপাস্য, আরাধ্য যেখানে—সেই খবর।
ব্যবসায়ীদের খবরও খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি আমরা। তারা অর্থনীতির চাকা, সমাজ বদলে তাদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে, এমন অজুহাতে তার খবর। কিন্তু ব্যবসায়ীরও প্রকৃত অপ্রকৃত রয়েছেন। সাধু, অসাধু রয়েছেন। লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় অর্থ উপার্জন, শ্রমিকদের নিপীড়ন, অনিয়ম, শুল্ক ফাঁকির টাকায় ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠা সেই সব ব্যবসায়ীদের খুব সামান্য টাকাই জনসেবার নামে উৎসর্গকৃত। সেই খবরে ভীষণ আপ্লুত আমরা।
সিনেমার কোন নায়িকা কার সঙ্গে শোবার ঘরে গেল কি গেল না, কারো সঙ্গে আদৌ প্রেম আছে কি নেই, চুমুটা ডামি শট নাকি হেরোইনের নিজের—এ সব খবর নিতে, খবর দিতেও উদগ্রীব আমরা।
মিডিয়া হচ্ছে, নতুন নতুন মিডিয়া হাউস। আলো ঝলমলে অফিস, বিশাল ভবন। খবরের স্তূপ সেখানে। কিন্তু খবরের ছেলেটি বা মেয়েটির খবর নেওয়ার খবর নেই কারো। গার্মেন্টসে যখন বেতন পায় না, যখন-তখন ছাঁটাই চলে, ছুটে যাই ক্যামেরা নিয়ে, নোটবুক নিয়ে। কাঠগড়ায় দাঁড় করাই মালিককে, দায়ী করি কর্তৃপক্ষকে। সেই খবর মুহূর্তেই আপ করি। ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার দেই। লাইক দেয়, বাহবা দেয় লোকে। খুব দায়িত্ব পালন করেছি! দায়িত্ব পালন করাইতো আমাদের দায়িত্ব।
কিন্তু মিডিয়ার খবর? যে মিডিয়া অন্যের তাবৎ খবর রাখে, সকল খবর দেয়, তার খবর কে রাখে? নিয়ম নেই, নীতিমালা নেই, বেতন নেই, বেতন কাঠামো ঠিক নেই। বকেয়া পড়ে থাকে মাসের পর মাস, বেতন পাওয়ার নাম নেই। মালিকরা কফি খান প্যান প্যাসিফিকে, হাওয়া বদল করতে যান অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপে। সে খবর কেউ রাখে? কোথাও পান থেকে চুন খসলে, অনিয়ম দেখলেই প্রতিবাদী হয়ে উঠি ভীষণ। কিন্তু নিজেদের ভেতরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ করি না। হয়তো ধরে নিয়েছি, এটাই মিডিয়াকর্মীদের নিয়তি ও জীবন।
গণমাধ্যমের খবর গণমাধ্যমেই হয় খুব বেশী হলে দুই কলাম। গণমাধ্যমের সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর আসে, তাদের বাড়িতে হামলার খবর আসে, চুরি-ছিনতাই, বাসায় ডাকাতির খবর আসে। স্থানীয় সাংবাদিকের বাড়িঘর ভাঙচুরের খবর আসে। কিন্তু তারা যে তাদের প্রতিষ্ঠানেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্যাতিত, সে খবর আসে? না, সে খবর রাখে না কেউ।
কর্মক্ষেত্রে নারী সাংবাদিক কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে সেমিনার হয়। মুক্ত আলোচনা হয়। কারণ ‘নারী’ বিষয়ে ফান্ড আছে। এনজিও আছে। এনজিওরা ফান্ড আনে। তাদের খরচ দেখাতে হয় মিডিয়া ক্যাম্পেইনে।
চাই প্রতিটি অনলাইনে, খবরের কাগজে, খবরে মিডিয়ার খবরও থাকুক। মিডিয়ায় মিডিয়ার খবরও আসুক। আমরা যারা মিডিয়াকর্মী, আমরাও মানুষ। কেন বিনা নোটিশে পত্রিকা, অনলাইন বন্ধ হয়ে যাবে, কেন বেতন বকেয়া থাকবে, কেন বেতন কাঠামোর বদলে ‘ইচ্ছা কাঠামো’ এখানে বলবৎ, এ সব নিয়ে আলোচনা চাই। মিডিয়াতেই চাই। অনলাইনে চাই, খবরের কাগজে চাই, টেলিভিশনে চাই, রেডিওতে চাই।
কথা হোক, স্বচ্ছতা আসুক, জবাবদিহিতা আসুক আগে, মিডিয়ার নিজের ঘরে। অন্যের খবর দেওয়ার আগে আসুন নিজের খবর দেই। নিজের খবর জানি আগে, জানাই আগে নিজেকে ও অন্যকে।
লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এ্যান্ড কমিউনিকেশন।
সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।