ঢাকা: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। আর সেখানেই আতঙ্কে রয়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। প্রতিদিনই ধরপাকড়ের শিকার হচ্ছেন তারা। দিন দিন এই ধরপাকড়ের মাত্রা বাড়ছে। বাসাবাড়ি, কর্মক্ষেত্র, হাট-বাজার, মসজিদ, রাস্তাঘাট কোথাও নিরাপদ নয় তারা। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে তাদের ধরা পড়ার ভয়ে। স্বল্প মেয়াদ থেকে শুরু করে দীর্ঘ মেয়াদে দেশটিতে অবস্থান করা কোন বাংলাদেশিই নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছেন না। শুধু কর্মীই নয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে ব্যবসা করে আসছেন এমন বাংলাদেশিও এখন আতঙ্কে।
আর ধরা পড়লেই সোজা ডিপোর্টেশন সেন্টার, তারপর কিছুদিন সেখানে রাখার পর সোজা দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের। এক্ষেত্রে বৈধ কাগজপত্র আছে কি নেই, সেই কৈফিয়তেরও তোয়াক্কাও করছে না সৌদি কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশটি থেকে ফেরত এসেছে ২০ হাজার ৬৯২ জন বাংলাদেশি কর্মী। যার মধ্যে গতমাসেই ফেরত এসেছে ৪ হাজার ৬৬২ জন। অক্টোবর মাসে প্রায় প্রতিদিনই ফিরেছেন কর্মীরা। এ তথ্য প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের। ফেরত আসা কর্মীদের অনেকের ভাষ্য, তাদের কাছে বৈধ কাজপত্র থাকার পরও ফেরত পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে, দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসও এ ব্যাপারে কোন সহযোগিতা করছে না। কর্মীদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে উল্টো কথা শুনিয়ে দেন দূতাবাস কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে অসহায় তারা।
সূত্র মতে, এর আগে বিভিন্ন সময় বিশেষ অভিযান চালিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ শ্রমিকদের আটক করতো। তারপর সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের ফেরত পাঠানো হতো। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে অবৈধভাবে অবস্থান করা কর্মীদের পাশাপাশি বৈধদেরও জোরপূর্বক ফেরত পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে এর মাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১০ মাসে ফেরত আসা ২০৬৯২ কর্মীর মধ্যে শুধু গত দুই মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই ফেরত এসেছে ৮০০০ কর্মী। যার মধ্যে অক্টোবরে সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। সূত্র বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৭৭১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৬৯ জন, মার্চে ২৩৪৮ জন, এপ্রিলে ৯৮৭ জন, মে মাসে ১৩১০ জন, জুনে ১৬০৩ জন, জুলাইয়ে ১৬৭৫ জন এবং আগষ্ট মাসে ১৫২৮ জন কর্মী সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতেও শতাধিক কর্মী ফেরত এসেছে।
ফেরত আসা কর্মীদের অনেকে শূণ্যহাতে এক কাপড়ে দেশে ফিরেছেন। টাঙ্গাইলের রহিম মিয়া বলেন, তিনি ১২ বছর ছি?লেন সৌদি আরবে। বৈধ আকামা থাকা সত্ত্বেও নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পুলিশ ধরে লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। সাতক্ষীরার জাহিদ হাসান জানান, মাত্র সাত মাস আগে তিনি সৌদি আরব যান। কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে আটক করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফেরত আসা সব কর্মীদের অভিযোগ একই।
ফেরত আসা কর্মীদের অনেকের বাড়ি ফেরার খরচও ছিলো না। হযরত শাহ্জালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছানোর পর এসব কর্মীদের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম খাবার-পানিসহ নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য জরুরি সহায়তা দিয়েছে। শুধু গতমাসে ব্র্যাকের সহযোগিতা পাওয়ার কর্মীদের মধ্যে রয়েছে ৪ঠা অক্টোবর ১৩০ জন, ৫ই অক্টোবর ১২০ জন, ৬ই অক্টোবর ৮৬ জন, ৯ই অক্টোবর ১০৫ জন, ১০ই অক্টোবর ৯৩ জন, ২১শে অক্টোবর ৭০ জন, ২৬শে অক্টোবর ২০০ জন, ২৭শে অক্টোবর ১৭৩ জন, ৩০শে অক্টোবর ১৫৩ জন এবং ৩১শে অক্টোবর ১০৪ জন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, চলতি বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার বাংলাদেশিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ বছরের কোন মাসে কত কর্মী ফিরেছে, সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর- এই দুই মাসে ধরপাকড় অনেক বেশি হয়েছে। তিনি জানান, গত আগস্ট মাসে সৌদি আরব থেকে এক হাজার ৫২৮ জন শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে ৩৩৩৯ জন ও অক্টোবর মাসে ৪৬৬২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যেসব শ্রমিক দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের অনেকেই এসেছেন একদম শূণ্য হাতে। অনেকে বিদেশে যাওয়ার খরচের টাকাটাও তুলতে পারেননি। সৌদি আরবে চলমান এই সমস্যা সমাধানে রিক্রুটিং এজেন্সি, বিদেশগামী শ্রমিক, দূতাবাসসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে বলে মত দেন ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে ওয়ারবি ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, অনেকে ফ্রি ভিসার নামে সেখানে যায়। আসলে ফ্রি ভিসা নামে কিছু নেই। মূলত: এক শ্রেণির দালালের যোগসাজসে ভিসা ট্রেডিং হয়। এই দালালচক্র নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ না থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে টাকা-পয়সা দিয়ে ডিমান্ড লেটার নেয়। পরে ওই কোম্পানির অধীনে ভিসা নিয়ে সেখানে গিয়ে অন্যত্র কাজ করে। কিন্তু কাজ না পেয়ে অনেকে ঘুরে বেড়ায়, আর তখনই তারা ধরপাকড়ের শিকার হয়। আবার অনেকে যে কোম্পানিতে কাজ করে, সেই কোম্পানির কাগজপত্র না দেখাতে পারায় ধরপাকড়ের শিকার হয়। এছাড়া বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক মালিক তাদের কর্মীদের ছেড়ে দেয়। সেক্ষেত্রে নতুন কর্মী নিয়ে গেলে সেও দালালদের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা পায়। এই অবস্থায় পুরাতন কর্মীরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। সাইফুল হক বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের লেবার এটাসের দায় রয়েছে। কারণ কোন কোম্পানিতে বা যার অধীনে যাচ্ছে সেখানে আদৌ কাজ আছে কিনা তা খোঁজ-খবর নেয়ার দায়িত্ব তাদের। তিনি আরও বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি সেদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টি সমাধান করার জন্য আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি। সরকার বিষয়টি নিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে।
এদিকে, বিপুল সংখ্যক এই পুরুষ কর্মী ছাড়াও গত নয় মাসে সহস্রাধিক নারী কর্মী দেশটি থেকে ফেরত এসেছে। এ তথ্য ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের।
অন্যদিকে, গত ১০ মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৪৬ হাজার ১৯১ বাংলাদেশি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪০২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৭২ জন, মার্চে ৩৮৪৪ জন, এপ্রিলে ৩০৪৬ জন, মে মাসে ৪২০৪ জন, জুন মাসে ২৪২৯ জন, জুলাইয়ে ৩৮৮০ জন, আগস্টে ৩৬৩৩ জন, সেপ্টেম্বরে ৮৭২৫ জন এবং অক্টোবরে ৯০৩০ জন।