ঢাকা: গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। একটি জাতি অবরুদ্ধ হয়ে গনতন্ত্রহীনতায় পড়লে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আর সেটাই মুক্তি সংগ্রাম। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদি গনতন্ত্র সক্রিয় না থাকে তবে জনগনের চাহিদার অপূরণীয়তা থেকে যায়। তৈরী হয় চাপা ক্ষোভ। এই অবস্থা থেকে আরো গুরুতর ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হল , গনতন্ত্র চলমান অবস্থায় ভিন্ন পোষাকে চর্চা। স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রের মালিক জনগন রক্ত দিয়ে শহীদ হয়। এটা চিরায়ত। কোন সংগ্রামই রক্ত না নিয়ে সফলতা দেয় না। তাই সংগ্রামে রক্ত যেন প্রধান উপাদান হয়ে গেছে আমাদের গনতন্ত্রে। গনতান্ত্রিক আন্দোলন অবশ্য রক্তের চাহিদাকে অপরাধ মনে করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গনতন্ত্র বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি রাজপথ গনতন্ত্রকামীদের জন্য নিরাপদ না হয়, তখন গনতান্ত্রিক আন্দোলন ঘুমট বেঁধে অন্য রুপ ধারণ করে। আবার গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গনতান্ত্রিক আন্দোলনের আক্রমনকারী বা চক্র যদি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করেন, তবে সেটা হবে গনতেন্ত্রর জন্য অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়। মানে হল, বাদী ও বিবাদী উভয়েই আইন প্রণেতার আসনে।
বলছিলাম এরশাদের শাষনামলের আগে ও পরের কথা। এরশাদকে স্বৈরাচার বলা হয়। এই স্বৈরাচারের হাতে গনতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, অভিযোগ আমাদের । গনতন্ত্র উদ্ধার করার জন্য আমরা ১৯৯০ সনে গনতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। এই আন্দোলনে একাধিক নেতা শহীদ হয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওই সকল সম্মানিত শহীদদে কবরে আমরা প্রতি বছর তাদের মৃত্যুর দিনে ফুল দিয়ে সম্মান জানাই। দোয়া করি। এটা গনতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মানের কাজ।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেন ও শহীদ মিলনদের দলে ছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। শহীদ ময়েজউদ্দিনের মেয়ে মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি গাজীপুর-৫(কালিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। আওয়াীলীগের গেলো সরকারের আমলে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এবার তিনি একই মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। শহীদ ময়েজউদ্দিনের মেয়ে যখন মহান জাতীয় সংসদের সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকার প্রধানের বিশেষ দূত ছিলেন ১৯৯০ সনের ৬ ডিসেম্বর উৎখাত করা স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একই সঙ্গে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ছিল সরকারী জোটের অংশ মানে সরকারের অংশ। ফলে সরকারী দলের প্রতিমন্ত্রী চুমকি ও সরকারী জোটের অংশ জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ একই রুপরেখায় ও একই সংসদে আসীন ছিলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে। যদিও ১৯৯০ সনে এরশাদ উৎখাত আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন ময়েজউদ্দিন। যার বিরুদ্ধে গনতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে বাবা শহীদ হয়েছেন, তার সাথে বসেই শহীদের মেয়ে একই সংসদে সরকার পরিচালনা করেছেন। করতে হয়েছে বলতে হবে এই কারণে যে, এটা গনতান্ত্রিক দেশ। গনতান্ত্রিক দেশ বলেই বাদী ও বিবাদী একই আসনে বসে আইন প্রনয়ন করেছেন দেশ পরিচালনার জন্য।
ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে গনতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদের সন্তান আসামীর সঙ্গে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এক যুগে কাজ করেছেন। এটা গনতন্ত্রের অবয়ব বললে ভুল হবে না, কারণ আমরা এই অবয়বের গনতন্ত্রেই আছি। আমরা আজ যাকে উৎখাতের জন্য গনতান্ত্রিক আন্দোলন করছি, কাল তাকেই আবার সরকারে বসাচ্ছি। এটা গনতন্ত্র হবে কি না জানিনা। তবে গনতান্ত্রিক আন্দালনে শহীদের সন্তান যখন বাবার খুনীর সঙ্গে একই সংসদে বসে সরকার পরিচালনা করেন তখন ওই সন্তানের কেমন লাগে, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না। এই প্রশ্নটার উত্তরে মাননীয় সংসদ সদস্য ও শহীদ ময়েজউদ্দিনের মেয়ে মেহের আফরোজ চুমকি ভাল বলতে পারবেন।
পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিযোগ আসতেই পারে, গনতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের রক্ত যদি খুনী বা খুনীদের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তবে গনতান্ত্রিক ইস্যু নির্ধারণে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার। গনতান্ত্রিক আন্দোলন হয়, দেশ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এই অধিকার যদি অধিকার ভঙ্গকারীর সঙ্গে মিলেমিশে সরকার পরিচালনা করা বুঝায়, তবে আমাদের উচিত গনতন্ত্রকে নিজেদের মত করে তৈরী করে তার প্রতিষ্ঠানিকরুপ দান করা। এটা হলে আর এই ধরণের প্রশ্ন আসবে না।
প্রসঙ্গত: ১৯৯০ সনের ২৭ সেপ্টেম্বর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন শহীদ ময়েজউদ্দিন। তিন দিন আগে পালিত হল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত বিশিষ্ট রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের নিবেদিত সংগঠক, শহীদ ময়েজউদ্দিনের ৩৫ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী।
সংবাদ মাধ্যম বলছে, ১৯৮৪ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সারাদেশে ২২ দল আহুত হরতালে গাজীপুরের কালীগঞ্জে মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেয়া কতিপয় সন্ত্রাসী তাঁর ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থালেই ময়েজউদ্দিন শাহাদৎ বরণ করেন। তাঁর শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে ২৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়হরা গ্রামে ১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ মোঃ ছুরত আলী ও শহরবানুর ঘরে শহীদ ময়েজউদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন । তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি এমপির পিতা।
ময়েজউদ্দিন ঐতিসাহিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিলের’ আহবায়ক ছিলেন। একজন বিচক্ষণ আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বৃহত্তর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কালীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে যথাক্রমে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস (বর্তমানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট) সোসাইটির নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি)’র মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শহীদ ময়েজউদ্দিন-এর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে উঠা প্রবল গণআন্দোলনে অবশেষে সামরিক শাসক ও শাসনের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের জয় হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিন একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সাধারণ জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ মানুষ হিসেবে ইতিহাসে এবং মানুষের হৃদয়পটে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গৌরবময় ভূমিকা পালন করায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান “স্বাধীনতা পদক”-এ ভূষতি করনে।
প্রধান সম্পাদক
গ্রামবাংলানিউজ