ভারতে জোর করে ধর্মান্তর

সম্পাদকীয়

index‘চোর এখন ধরা পড়েছে। আমার মাল চোরের কাছে। আর এটা বিশ্ব জানে। আমি আমার মাল ফেরত নেব। এটা এমন কী বড় ব্যাপার।’ কথাগুলি বলেছেন ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতা মোহন ভাগবত। ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ আর এস এসের প্রধান।

রাজনৈতিক ইস্যু করতে মানুষকে ‘মালের’ সঙ্গে তুলনা করার জন্য শুধু এই বিবৃতি আপত্তিজনক নয়, এতে রয়েছে তাবৎ সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি সরাসরি হুমকি। ভাগবত আরও বলেছেন, ‘খামোকা আমরা ভয় পেতে যাব কেন? আমরা তো অণুপ্রবেশকারী নই, আমরা বিদেশীও নই। এটি একটি হিন্দু রাষ্ট্র।’

কয়েক দশক আগে ভাগবতের পূর্বসূরি মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার লিখেছিলেন ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’। আমরা বা আমাদের জাতিত্বের সংজ্ঞা। হিটলার তার কাছে ছিল নায়ক। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদি হিটলারকে মনে করেন প্রেরণা, লিখেছেন তার জীবনী। আর এস এসের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকার বলেছিলেন, বিদেশীদের জন্য দু’টি পথই খোলা আছে: হয় ভারতীয় জাতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে, গ্রহণ করতে হবে তার সংস্কৃতি, অথবা থাকতে হবে দয়ার উপর। ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে।

এবং এখানে ‘ঘর ওয়াপসি’তে কোনো ভুল নেই। তথাকথিত ‘ঘরে ফেরার কর্মসূচি’, যার আগ্রাসী অনুশীলনে মরিয়া সঙ্ঘপরিবার। যা গোলওয়ালকারের ‘মিশে যাওয়ার’ তত্ত্বের নতুন পরিশব্দ। এই ধর্মান্তর হচ্ছে চোখ রাঙিয়ে, হুমকি দিয়ে। এই ধর্মান্তর হচ্ছে সামাজিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করে।

কলকাতার সভায় ভাগবতের এই বিবৃতি সংবিধান বিরোধী। দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরির দায়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উচিত ছিল তার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩(এ) উপধারায় মামলা করা। সমস্ত ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচিই একইভাবে বেআইনি এবং আইনের লঙ্ঘন। ‘ঘর ওয়াপসি’তে নেই কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস। এটি সরাসরি একটি রাজনৈতিক স্লোগান। হিন্দুত্বের বিকৃত চোখে ইতিহাস দর্শন। যার দাবি, সমস্ত ভারতীয়র রয়েছে ‘হিন্দু শিকড়’, ‘হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ও খ্রীস্টান ধর্মে’ ধর্মান্তর করা হয়েছে, যা ‘বিদেশীদের’ ধর্ম, সেকারণে সবাইকে হিন্দুত্ব পরিবারের ‘ঘরে’ ফিরিয়ে আনা হলো জাতীয় কর্তব্য।

বিজেপি শাসিত রাজ্যে ধর্মান্তর-বিরোধী আইনের লক্ষ্য খ্রীস্টান ও মুসলিম ধর্মান্তরকরণ, যেখানে তথাকথিত ঘরে ফেরার ডাক, ‘শুদ্ধিকরণ’ কর্মসূচি নিয়মিত হচ্ছে আইনের আড়ালে। ভাগবত যখন অমিত শাহ, ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মতো ‘ধর্মান্তর-বিরোধী আইন’ বিরোধীদের মেনে নিতে বলেন, তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন: তারা কি ঘর ওয়াপসি-কে ‘বলপূর্বক ধর্মান্তর’ বলে তাতে যুক্ত করবেন? তাদের জবাব দিতে হবে ভারতীয় সংবিধানের ২৫নম্বর ধারাকে কি তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন? আসলে ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে দ্বিচারিতার পথ নিয়েছে বি জে পি এবং আরএসএস। দু’মুখো কথা বলছে। একদিকে পুনর্ধর্মান্তরকরণ প্রচার চালাচ্ছে, আবার একইসঙ্গে বলপূর্বক ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করতে একটি আইন তৈরির দাবি জানাচ্ছে। বাস্তব হলো ভারতে এমন কোনো আইনের আদৌ প্রয়োজন নেই। কারণ চলতি আইনেই এই অন্যায় মোকাবিলার সংস্থান রয়েছে।

ভারতীয় সংবিধানের ২৫নম্বর ধারায় ‘ধর্মাচরণ, ধর্মীয় বিশ্বাস বেছে নেওয়া ও অনুসরণের অবাধ অধিকার এবং ধর্মীয় প্রচারের স্বাধীনতা’ স্বীকৃত হয়েছে। বলপূর্বক ধর্মান্তরের কোনো ঘটনা ঘটলে তা ইতোমধ্যেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩(এ) উপধারায় আনার সংস্থান রয়েছে। এই উপধারা অনুযায়ী ধর্মের নামে বলপ্রয়োগ করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। বরং, এই আইন প্রয়োগ করেই আর এস এস মদতপুষ্ট পুনর্ধর্মান্তরকরণ প্রচার অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা উচিত। ঘর ওয়াপসিকে বেআইনি ঘোষণা করা উচিত। কারণ এই ধরনের অপতৎপরতা গোটা উপমহাদেশেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সঙ্কটের জন্ম দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *