২৮ বছর পর একটি নির্বাচন! সাংবাদিক হিসেবে এমন একটি নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের ‘পরচিয়পত্র’ পেয়ে বেশ রোমাঞ্চিতই ছিলাম। উপরন্তু নির্বাচনস্থল বিদ্যাপীঠ হওয়ায় এর সাথে মিশ্রিত ছিল আবেগও। রাজনৈতিক প্রতিবেদক হওয়ায় সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর নজির মনস্তত্ত্বে ঠিকই ছিল, কিন্তু মন তাতে সায় দিতে চায়নি। হয়তো ভেবেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত এমনটি হবে না। সকাল সকাল ‘পাঠাও’ ডেকে তাই পৌঁছে গেলাম শাহবাগ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রবেশদ্বার।
সোমবারের বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক অন্য দিনগুলোর মতো ছিল না। বিধিনিষেধে মোড়া এর চতুর্দিক। পুলিশি ব্যারিকেড। বিএনসিসি ও স্কাউটের সদস্যরা পুলিশকে সহায়তা করছেন প্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকতে তেমন বেগ পেতে হলো না। তেমন ভিড় ছিল না এই প্রবেশপথে। সামনের দিকে হেঁটে আরেকবার পেছনে তাকাতেই চোখ পড়ল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বেশ কয়েকটি গাড়ি জাদুঘরের সামনের রাস্তায় পার্ক করা রয়েছে।
ডাকসু নির্বাচন শুরু হয়েছে সকাল ৮টায়। আমি যখন যাচ্ছি তখন ভোটের ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে কেমন ভোট হচ্ছে, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ কিছু কিছু গণমাধ্যমে। জাতীয় কবির মাজার পেরিয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখ পড়ে বড় বড় ছবিতে ছেয়ে যাওয়া পোস্টারে। পোস্টারে আধিপত্য ছাত্রলীগেরই। ভোট চেয়ে বিশাল আকৃতির সব পোস্টার সাঁটিয়েছেন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ভিপি, জিএস, এজিএস প্রার্থীরা। তাহলে ছাত্রদলের পোস্টার কোথায়? আরেকটু এগিয়ে যেতে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজের পোস্টার চোখে পড়ল। বড় পোস্টারের ভিড়ে এই পোস্টারটি যেন হারিয়ে গেছে।
মধুর ক্যান্টিনের উল্টো পাশে ডাকসু ভবন। দোতলা ছোট ছিমছাম এই ভবনটি ঘিরে তেমন কোনো কোলাহল চোখে পড়ল না। এখন সবাই ব্যস্ত ভোটকেন্দ্রে। মধুর ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে কলা ভবনের পেছনের রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পাসসংলগ্ন মাস্টার দা সূর্যসেন হলের দিকে এগিয়ে যাই। পথেই দেখা হয় হলের এক ছোট ভাইয়ের সাথে। ‘ভাই, কেমন আছেন, ভোট তো সেই রকম হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো, ফাটাফাটি।’ মিনিটখানেক কথা বলে এলাম সূর্যসেন হলে। বেশ জটলা। একটু আগেই এই হলের ভোট দেখে বেরিয়ে গেছেন ছাত্রদলের প্রার্থীরা। হলে প্রবেশ ফটকে দেখা হয় আমার ঘনিষ্ঠ দুই সাংবাদিকের সাথে। তারা ভোট নিয়ে বেশ আলোচনায় মেতে উঠেছেন। কথা থেকে বোঝা গেল দু’জনই সূর্যসেন হলের প্রভোস্টের সাথে কথা বলে বাইরে এসেছেন।
‘নাহ, খুবই লজ্জার। বিশ্ববিদালয়ের মান-ইজ্জত সব ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল’ ওই প্রভোস্টেরই এমন উক্তি। কুয়েত-মৈত্রী হলে সিল মারা ব্যালটভর্তি বস্তা উদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রভোস্ট এমন কথা বলেছেন, তা আর বুঝতে বাকি রইল না। আমার সাথে থাকা রিপোর্টার শফিকুল ইসলাম ও সিনিয়র ফটোগ্রাফার শফিউদ্দিন বিটু ভাইকে নিয়ে সূর্যসেন হলে প্রবেশ করলাম। ভোটারের দীর্ঘ লাইন। কৃত্রিমভাবে জটলা পাকানো গেট কষ্ট করে পার হলাম। ওই গেটে তখন নানা কানাঘুষা চলছিল। ‘সবাইকে দাঁড়াইয়্যা থাকতে বল’, ‘২টা পর্যন্ত কেউ যেন না নড়ে।’ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত এক ছাত্র লাইনের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে, তাকে কে যেন বলল ‘দাঁড়িয়ে থাক আরো ২ ঘণ্টা।’ সাংবাদিক হিসেবে সূর্যসেন হলে ভোটের দীর্ঘ লাইনটি দেখার সৌভাগ্য হলো মাত্র, আর্চওয়ে পেরিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া তো দূর কি বাত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা নোটিশ- ভোটার ছাড়া কারোরই অনুমতি নেই ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের। মনে মনে ভাবলাম তাহলে মিডিয়ার কাজ কী! গত্যন্তর না দেখে বেরিয়ে গেলাম পাশের হল হাজী মুহাম্মদ মুহসীনে। হলের অডিটোরিয়ামে ভোট হচ্ছে। এখানেইও সেই দীর্ঘ লাইন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন ভাই? জবাব এলো- দুই-আড়াই ঘণ্টা তো হবেই।
গতকাল গরমটাও কেমন যেন ভ্যাপসা ছিল। সেই গরমে হাঁসফাঁস অবস্থায় শতশত ছাত্রকে ঠাঁই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মুহসীন হল থেকে বের হওয়ার পথে এক ছাত্রের সাথে কথা বলি, কেন এরকম দীর্ঘ লাইন? কেউ নড়ছে না কেন? ছাত্রের উত্তর-‘এটিই নির্দেশ। লাইনে যারা আছে সবাই ছাত্রলীগেরই। অন্য কারো সুযোগ নেই। হলেতো থাকতে হবে।’ জাতীয় নির্বাচনেও এমনটি দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রের সামনে লাইন। আর ওই লাইনে যারা ছিলেন সবাই একটি দলেরই সমর্থক। মুহসীন হল থেকে কবি জসীম উদ্দীন হলে এসে দেখা গেল একই চিত্র। এক ছাত্র এ সময় বলছিলেন- ‘মেয়েরাই দেখাল।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়- কুয়েত মৈত্রী হলে বস্তাভর্তি ব্যালট উদ্ধার করেছে মেয়েরাই। তারা সেখানে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। কাউকে পাত্তা না দিয়ে হলের রিডিং রুম থেকে বস্তাভর্তি সিল মারা ব্যালট বের করে নিয়ে এসে ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। এরপর থেকেই সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। জালিয়াতির প্রমাণ মেলায় প্রভোস্টকেও বরখাস্ত করা হয়। রোকেয়া হল, কবি সুফিয়া কামাল হলেও মেয়েদের প্রতিবাদ ওঠে জালিয়াতির বিরুদ্ধে।
জসীম উদ্দীন হল থেকে বেরিয়ে বিজয় ’৭১ হলের সামনে এমন ভোট সংগ্রহের সাক্ষী হতে শুরু হয় সহকর্মীদের সাথে ফটোসেশন। এ সময় বিজয় ’৭১ হলে ছাত্রলীগের একটি কক্ষ থেকে ব্যালট উদ্ধারের খবর আসে। বেলা ২টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ। ফটোসেশনে খুব বেশি সময় না নিয়ে চলে গেলাম মধুর ক্যান্টিনে। নিরিবিলি-নিরুদ্বেগ আড্ডা চলছে। এক কর্নারে বন্ধু মিনহাজের সাথে দেখা হলো। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। বলল- ‘এত দিন নির্বাচন হয়নি, তাও ভালো ছিল। এমনভাবে কলঙ্কিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাবা যায় না।’ এ সময় সাংবাদিক শফিক বলে ওঠে, ‘ডাকসুর ভোটের লাইন বড় হয়, কিন্তু মধুর ক্যান্টিনের মিষ্টির সাইজ বড় হয় না।’ মধুর ক্যান্টিনের মিষ্টির আকার সত্যিই খুব ছোট। এটিই নাকি ঐতিহ্য।
মধুর ক্যান্টিন হয়ে রোকেয়া হলের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলাম। খবর পেলাম একটু আগেই বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুরের ওপর হামলা হয়েছে। সবাই তখন বলাবলি করছিল-ছাত্রলীগের মেয়েরাই এই হামলা চালিয়েছে।
এমন সব অনিয়মের মধ্যেই বিভিন্ন প্যানেলের ভোট বর্জনের খবর আসতে থাকে। বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের সময়সীমাও তখন শেষ হয়ে আসছিল। ভিসির বাসার পাশে ফুলার রোডে এক স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করে যখন বেরিয়ে আসি, তখন মুহুর্মুহু স্লোগান ভেসে আসে। ভিসি ভবন ঘেরাও করেছে ছাত্রদল। ‘প্রহসনের ভোট মানি না, মানব না।’ ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের কার্যালয়ের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে একটি প্রতিবাদী দেয়াল চিত্রÑ ‘১১ মার্চ ঢাবির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’ যেটি লেখা হয়েছে খানিক আগে।