ঢাকা: ব্যান্ডদল এলআরবির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর সাক্ষাৎকার। এক চিরতরুণ রকস্টারের স্বপ্নগাঁথার কথা উঠে আসে ওই সাক্ষাৎকারে। তাঁর স্মরণে পুরোনো সেই সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশিত হলো।
এ বছর ব্যান্ডদল এলআরবির বয়স হলো ২৫। ব্যান্ডটির সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেই আইয়ুব বাচ্চুর যাত্রা অবশ্য শুরু হয়েছিল তারও অনেক আগে। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের এক হোটেলে। এরপর কীভাবে তিনি আজকের ‘এ বি’ হয়ে উঠলেন? এক চিরতরুণ রকস্টারের স্বপ্নগাথা
আমার সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে আমার মুখে একটা গল্প শুনে অভ্যস্ত। এই ঢাকা শহরে ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। উঠেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে। সেই আমি কিন্তু এখনো কাজ করে খাচ্ছি। পরিবার-বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে ভালোই আছি।
ঢাকা শহরে আমি যখন ৬০০ টাকা নিয়ে আসি, তখন এখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতেন। আমি কারও কাছেই যাইনি। বিপদে কারও মুখাপেক্ষীও হইনি। নিজেকে গড়ে তুলেছি। কাজে হাত দিয়েছি। কাজের পর কাজ করেছি। এখনো করেই যাচ্ছি। দিনরাত্রি কাজ করে একটা অবস্থানে পেঁৗছাতে পেরেছি।
আমার কাছে ওই ৬০০ টাকা ছিল ৬ কোটি টাকার মতোই। সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। সবকিছু পাশ কাটিয়ে গেছি। চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল, যাদের নাম শুনলে আতঙ্কিত হতে হতো। শুধু তা-ই নয়, আমার পরিচিত অনেকে মাদকসেবনও করত। চাইলে আমিও হয়তো বখে যেতে পারতাম। কিন্তু মিউজিকই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি সেই লক্ষ্যে ছুটে গেছি।
১০ বছর লেগেছে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে। এই ১০ বছরে আমি ভেসে যেতে পারতাম। হয়তো আমার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। কিন্তু আমি ভাসিনি। আশপাশে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেক ধরনের লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে লাইফস্টাইল আমার পরিচিত না, যেটার সঙ্গে আমার পরিবার একমত না—এ ধরনের লাইফস্টাইল থেকে নিজেকে সংবরণ করেছি। কারণ, আমার মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে। আত্মীয়স্বজনেরা মন ছোট করবেন। দেশ কষ্ট পেলে দুনিয়া কষ্ট পাবে। এ জন্যই নিজেকে সংবরণ করেছি। আমি বলতে চাই, লোভ সংবরণ করা খুব দরকার।
এখন আমি যদি কাউকে বলি, ধরো তোমাকে ১০ কোটি টাকা দিলাম। আজ রাতের মধ্যেই খরচ করতে হবে। এক রাতের মধ্যে কি এই লোকটার পক্ষে ওই টাকা খরচ করা সম্ভব হবে? যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে কিসের এত ক্রোধ, হিংসা লোভ! কী নিয়ে এত দৌড়ঝাঁপ!
১৯৮৩ সালে আমি সোলস ব্যান্ডে ছিলাম। ১৯৯১ সালে এলআরবি গঠন করি। আমার মনে হয়, মানুষ চাইলেই সবকিছু সম্ভব। অবশ্যই সেটা ইতিবাচক।
আমি সব সময় একটা কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, তরুণেরাই আগামী। যেহেতু তরুণেরাই আগামী, সেহেতু তরুণদের দিয়ে ভুল কিছু হবে না। শুধু আমার নয়, এটা ৬৮ হাজার গ্রাম এবং সাড়ে ১৬ কোটি মানুষেরও বিশ্বাস বলে মনে হয়। ঢালাওভাবে তরুণদের যেন অপবাদ দেওয়া না হয়। আমাদের দেশে অসংখ্য মেধাবী তরুণ আছে। এই অসংখ্য উদ্যমী তরুণের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজের মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়েরা।
এই তরুণদের থেকে বেরিয়ে এসেছে আর্টসেল, চিরকুট, নেমেসিস, শূন্য, জলের গান, ব্ল্যাকের মতো ব্যান্ড। এই তরুণদের কাছ থেকেই আমরা পেয়েছি শাকিব খান, আরিফিন শুভ, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, ন্যান্সিসহ আরও অনেককে। এই তরুণদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম, ওয়াসফিয়া নাজরীন, এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদারকে। আরও আসবে। আসতেই থাকবে। ক্রিকেটার, গানের মানুষ, অভিনয়ের মানুষ—সবই আসবে এই তরুণদের থেকে।
তরুণেরা ভুল কিছু করবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। বিপথগামী আর তরুণ এক নয়। সম্পূর্ণ আলাদা দুটি শব্দ এবং আলাদা দুটি সত্তা। তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গায় নিয়ে যাবে।
তরুণদের প্রতি আমার শুধু বলা, যদি মানুষকে ভালোবাসো, তবে দেশকে ভালোবাসো। দেশকে ভালোবাসলে মাকে ভালোবাসো। যদি মা ও দেশকে ভালোবাসো, তাহলে এ দেশের মাটিকে ভালোবাসো। মাটিকে ভালোবাসলে মানুষকে ভালোবাসো।
আমি দুই সন্তানের বাবা। সন্তানদের লালনপালনের গুরুদায়িত্বটা আমার স্ত্রী পালন করে যাচ্ছে। বাবা হিসেবে আমি তো আছিই। আমি আমার সন্তানদের সব সময় বলি, আগে তুমি মানুষ হও, শিক্ষা নাও, মানুষকে শ্রদ্ধা করো, মানুষকে ভালোবাসো, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকো; তারপর তোমার নাম হবে, বংশপরিচয় আসবে অনেক পরে। তোমার কাজই তোমাকে পরিচিত করে তুলবে। টাকা-ব্যাংক-ব্যালান্স, পদ-পদবি—সবই আসবে। আগে মানুষকে ভালোবাসো।
৬০০ টাকা সঙ্গী করে আর বুকে বিরাট এক স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ৩৩ বছর আগে আমি আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলাম। আমি এখনো সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটছি। স্বপ্নটা আমার এখনো পূরণ হয়নি। আমার সেই স্বপ্নটা হচ্ছে, বাংলা গান পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়াবে।