মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
অচেনা মানুষ হিসেবে এই চিঠি আপনাকে লিখছি না। আমাকে চেনেন আপনি। দেশে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল আপনার সঙ্গে। তখন, নব্বইয়ের শুরুর দিকে আপনাকে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে মৌলবাদীদের মিছিল হওয়া, আমার মাথার দাম ঘোষণা হওয়া, লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছি এই অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে খালেদার সরকারের মামলা করা, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া, দেশ ত্যাগ করতে আমাকে বাধ্য করার পর আমি অপেক্ষা করতাম আপনি কবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আমি ভাবতাম আপনি প্রধানমন্ত্রী হলেই আমি দেশে ফিরতে পারবো। ঠিকই আপনি প্রধানমন্ত্রী হলেন একদিন। আমি তখন আপনার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি, কিন্তু আমাকে দেশে তো ঢুকতে দিলেনই না, উল্টো ভয়ংকর একটি কাজ করলেন। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামে আমার আত্মজীবনী গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করলেন। নিষিদ্ধ করার কারণ, আপনি জানালেন, বইটি অশ্লীল। আমার মেয়েবেলা আমার শৈশবের কাহিনি। এটিকে আপনি ছাড়া আর কেউ অশ্লীল বলেনি। বিদেশের অনেক ভাষায় বইটি ছাপা হয়েছে। খুব ভালো রিভিউ বেরিয়েছিল সেসব দেশে।
এমন কী বইটি বাংলা ভাষার অন্যতম একটি সাহিত্য পুরস্কার ‘আনন্দ পুরস্কার’ও পেয়েছিল। বইটি আজও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। সাধারণত যেসব সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তারা লেখকদের বই নিষিদ্ধ করে। তখন বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষেরা সেইসব সরকারের বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করে। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ তাই করে। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কারও বুকের পাটা নেই কোনও বই থেকে নিষিদ্ধকরণ তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার। নাৎসিরা যখন বই পোড়াতো, তাদের বই পোড়ানোয় কেউ বাধা দিতে পারতো না, তাদের সাহস ছিল না নাৎসি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার। কিন্তু আপনি তো নাৎসি সরকার নন, কেন মানুষ আপনার সরকারকে ভয় পায়! আপনি সম্ভবত বই নিষিদ্ধ করাটা শিখেছেন খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়া এর আগে আমার ‘লজ্জা’ বইটি নিষিদ্ধ করেছিলেন। খালেদা জিয়ার মতো আপনিও আমার বই পড়ার অধিকার থেকে বাংলাদেশের পাঠকদের বঞ্চিত করছেন।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, অন্য কারও বই নিষিদ্ধ করলে সরকারকে সামান্য হলেও ঝামেলা পোহাতে হয়। অন্যরা মামলা করে, হাইকোর্ট থেকে বইকে মুক্ত করিয়ে আনে। কিন্তু আমার বই নিষিদ্ধ করলে আপনাদের কোনও ঝামেলা পোহাতে হয় না। এই একটি মানুষ যাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, যাকে অকারণে অপবাদ দেওয়া যায়, যাকে যত খুশি অসম্মান করা যায়, অপমান করা যায় নিশ্চিন্তে, কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করবে না। আমার বেলায় দেশের অমৌলবাদীরাও মুহূর্তে মৌলবাদী হয়ে ওঠে। আমাকে আমার বাকি জীবন দেশে ফিরতে না দিলেও, আপনি ভালো জানেন, খালেদা জিয়াও জানেন, আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না, আপনাদের জনপ্রিয়তায় কোনও আঁচড় পড়বে না।
আমি দেশে ফিরতে চেয়েছি। আপনি সোজা বলে দিয়েছেন, দেশে যেন না ফিরি। কেন নিজের দেশে আমি ফিরবো না, তার কোনও কারণ আপনি অবশ্য দেননি। ঠিক খালেদা জিয়া যেভাবে আমাকে দেশে ফিরতে দেননি, একই পদ্ধতিতে আপনিও আমাকে দেশে ফিরতে দেননি। আমার মা’ যখন মৃত্যুশয্যায়, আমি কত যে অনুরোধ করেছি মা’র শেষ দিনগুলোয় তার পাশে যেন কিছুদিন আমাকে থাকার অনুমতি দেন। আপনি অনুমতি দিলেন না। শেষ পর্যন্ত আপনার রক্তচক্ষু অমান্য করে আমি দেশে ফিরেছিলাম। ভাগ্যিস আমার পাসপোর্টের তখনও বৈধতা ছিল। আমি দেশে ফিরেছি জানতে পেরে আপনি আমার ওপর এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে ঠিক খালেদা জিয়ার মতো আমার বিরুদ্ধে মামলা করে, আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, একইরকম নাটক করে আমাকে দেশ থেকে তাড়ালেন। খালেদা জিয়া আর আপনার মধ্যে চুলোচুলি থাকলেও আমাকে লাঞ্ছিত করার ব্যাপারে আপনারা দু’জন কিন্তু একশ ভাগ এক।
আমার বাবা যখন দেশে মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁকে অন্তত দু’দিনের জন্য হলেও দেখতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে কেঁদেছি, কিন্তু আপনি অনুমতি দেননি। আমার পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ করেননি। আমি ভেবেছিলাম, যেহেতু নিজের বাবাকে আপনি খুব ভালোবাসেন, আপনি হয়তো বুঝবেন, কোনও কন্যাকে একবার শেষবারের মতো তার বাবাকে দেখতে কেউ যদি বাধা দেয়, তবে সে কতবড় অন্যায় করে। আমার বাবা মারা গেছেন, আমাকে তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। আপনার অজানা নয় যে আপনারা আমাকে আজ কুড়ি বছর হলো দেশে ফিরতে দিচ্ছেন না। সম্ভবত ফিরতে দেবেনও না আর। বিদেশ বিভুঁইয়ে আমাকে বাকি জীবন পার করতে হবে। দেশে ফেরার আশা আজকাল আর করিও না। আমার সমস্ত আশা চূর্ণ হতে হতে এখন অবশিষ্ট কিছু নেই। বিদেশে কী করে বাস করতে হচ্ছে আমাকে, আমি জানি না, কতটুকু জানেন। তবে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন যে, আমি ভালো নেই। বাংলা ভাষার একজন লেখক বাংলার বাইরে বসে বাংলা ভাষায় বই লিখে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশেষ করে, সেসব বই যখন একের পর এক নিষিদ্ধ হয়, সরকারের ভয়ে যখন প্রকাশকরা বই ছাপানো বন্ধ করে দেয়, যখন বই ছাপায় পাইরেসির চোরেরা, বই বিক্রির কোনও রয়্যালটি যখন লেখকের হাতে পৌঁছোয় না। আমার জায়গায় আপনি হলে, আপনি কোনও বাঙালি লেখক হলে, আপনাকে যদি জোরজবরদস্তি নির্বাসন দেওয়া হতো, আপনারও অবস্থা করুণ হতো। আপনি কখনও কি আমার জায়গায় আপনাকে কল্পনা করে দেখেছেন? আমার মনে হয় না।
দেশে না থাকার কারণে আমার বাবার অঢেল সহায় সম্পত্তি থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে আমার এবং আমার বোনের যা প্রাপ্য তা থেকে আমাদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেছে আমার ভাইয়েরা। কত সহজেই পুরুষেরা অসৎ উপায়ে মেয়েদের সহায় সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিতে পারে। গত দু’দশক যাবৎ নারীর সমানাধিকারের পক্ষে লিখে দেশের নারীবিরোধী লোকদের চক্ষুশূল হয়েছি আমি। আপনি নিজে নারী, নারীর অধিকারের কথা আপনিও বলেন, আর আপনার শাসনামলেই কত নারীর মানবাধিকার কতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে! উত্তরাধিকার দাবি করতে গেলে, যেহেতু আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছেন না, কাউকে আমার পাওয়ার অব এটর্নি দিতে হয়। শান্তিনগরে আমার নিজের কেনা অ্যাপার্টমেন্টটি বিক্রি করে বিদেশে থাকার খরচ চালানোর চেষ্টা আজ অনেক বছর ধরে করছি কিন্তু পারছি না। না পারার কারণ হলো সরকারি বাধা। আমার ছোট বোনকে ‘পাওয়ার অব এটর্নি’ দিতে চাইছি, সমস্ত ডকুমেন্টস তৈরি, নোটারি পাবলিকের কাগজ, মানিঅর্ডার, অ্যাপার্টমেন্টের দলিল, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, আমার বাংলাদেশ-পাসপোর্টের কপি পাওয়ার অব এটর্নির জন্য যা যা চাওয়া হয়, তার সব কিছু নিউইয়র্কের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিজে গিয়ে ডেপুটি কনস্যুলার জেনারেল শহিদুল ইসলামের হাতে দেওয়ার পরও তিনি কিছুই এটেস্টেড করেননি। না করার কারণ, আমার নাম।
আমার নামটি ওঁর পছন্দ নয় অথবা আমার নামে ওঁর ভয়। আপনাকে না জিজ্ঞেস করে উনি কোনও সই দিতে চাইছেন না। দূতাবাস থেকে এটেস্টেড বা সাক্ষ্য-সই না হলে আমার কাগজপত্রগুলোর কোনও মূল্য বাংলাদেশে নেই, দেশে আমার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা যাবে না। মুশকিল হল, আমার নামটা দেখে দূতাবাসের কোনও প্রাণী আমার কোনও ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেন না। সিদ্ধান্তের জন্য আমার আবেদনপত্র পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ে, যে মন্ত্রণালয় থেকে কখনও কোনও উত্তর আসে না। গত কুড়ি বছর আমাকে উপেক্ষা করার মন্ত্র ছাড়া আর কোনও মন্ত্রের উপদেশ বর্ষিত হয়নি বাংলাদেশের কোনও মন্ত্রণালয় থেকে। আমার পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণের এবং আমার পাওয়ার অব এটর্নির অগুনতি আবেদনপত্র পড়ে আছে মন্ত্রণালয়ের ময়লা ফেলার বাক্সে।
আমার দেশে ফেরার অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করছেন। আপনার বিবেক কী করে বলছে আমি যেন আমার দেশের সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হই! এতটা অমানবিক কী করে হতে পারে মানুষ! কী অন্যায় করেছিলাম, কার কী ক্ষতি করেছিলাম যে আমাকে জীবনভর ভুগতে হবে, ঘুরতে হবে এক দেশ থেকে আরেক দেশ শুধু একটু আশ্রয়ের আশায়! আমার আজ পায়ের নিচে মাটি নেই। আমার মাথার ওপর ছাদ নেই। জানি না এসব খবর আপনাকে কোনও আনন্দ দেয় কি না। আমি আজ এই কথা বলতেই চিঠিটি লিখছি যে, আমার ঢাকার অ্যাপার্টমেন্টটি বিক্রি করার দায়িত্ব যে আমি আমার বোনকে দিতে চাইছি, তা যদি বৈধভাবে না দিতে পারি, তবে অ্যাপার্টমেন্টটি যে কেউ এসে যে কোনওদিন দখল করে নিতে পারে, যেমন নিচ্ছে গত কয়েক বছর। আপনার মনে হতে পারে সম্পত্তি হিসেবে ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা শান্তিনগরের পুরোনো একটি অ্যাপার্টমেন্ট নিতান্তই তুচ্ছ। হয়তো তুচ্ছ, আমার কাছে কিন্তু তুচ্ছ নয়। এটি বেদখল হয়ে গেলেও আমি জানি আপনার কিছু যাবে আসবে না। আমি যে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি, তাতেই বা কার কী যায় আসে!
তারপরও আমি আপনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি বিষয়টি। মৌলবাদীরা চায় না বলে আমাকে আমার নিজের দেশে ফিরতে দেবেন না জানি। এখন প্রশ্ন, আমার পাওয়ার অব এটর্নিতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সই করার জন্য আপনি কি অনুমতি দেবেন নাকি আমাকে বুঝে নিতে হবে নিজের সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব কারও ওপর দেওয়ার অধিকার দুনিয়ার আর সবার থাকলেও আমার থাকতে পারে না, কারণ আমার অপরাধ আমি কিছু বই লিখেছিলাম, যেসব বই দেশের মৌলবাদীর পছন্দ হয়নি! মৌলবাদীদের দোসর হিসেবে আপনাকে দেখতে চাই না বলেই এই চিঠি।
শ্রদ্ধাসহ
তসলিমা নাসরিন
নির্বাসন