ঢাকা: বাঙালির অনেক গুণ। তার মধ্যে একটা হলো বাঙালি অ্যামিবার মতো দ্রুত আকার পরিবর্তন করতে এবং বিভক্ত হতে ভালবাসে। বাইপোলার ডিজঅর্ডার নামে মানসিক রোগে আক্রান্তরা ক্ষণে ক্ষণে সুখ-দুঃখের দোলায় উথালপাতাল হন। সুখ-দুঃখের মাত্রাছাড়া অনুভূতি তার মানসিক ভারসাম্য ছেড়াবেড়া করে ফেলে। সুখের সময় প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে নিজেকে বিরাট কিছু মনে হয়। দুঃখের ধাক্কায় নির্জীব পড়ে থাকার কথা নাই-বা বললাম। বাই অর্থ দুই, আর পোলার অর্থ মেরু বা দিক। বাংলায় দ্বিমেরু বিভ্রাট। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশিরা মনে হয় দ্বিমেরু বিভ্রাটের শিকার। বাঙালির সামনে যেকোনো ইস্যু দেন, ইস্যুটাকে এবং নিজেদেরও এরা দুই পক্ষে ভাগ করে ফেলবে। ব্যক্তির বেলায় বাইপোলারিটি ভুক্তভোগী এবং তার বন্ধু-পরিজনকে ভোগায়। দেশের বেলায় সেটা একটা জাতীয় মানস-সংকট।
দেশে যা হয়, একদল তার সব কিছুকে ভালো পায়। আরেকদল সবকিছু নিয়েই হতাশ। একদল বন্দুকযুদ্ধ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, গণতন্ত্রহীনতা এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা গায়েবের মধ্যেও কোনো বৃহত্তর মঙ্গলের গন্ধ পান। অন্যদল, সমালোচনা-গালাগালাজ করে হয়রান হয়ে বসে পড়েন, পরিস্থিতি বদলের কোনো দিশা বা জিদ তাঁদের মধ্যে কম। এর বাইরেও অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁরা এখন পদ্মার ইলিশের মতো—বাজারে ছয়লাব হওয়া নকল ইলিশের ভীড়ে লজ্জিত ও কোণঠাসা।
হালসময়ে আমাদের জাতীয় বাইপোলারিটির তিনটা ঘটনা নেয়া যাক।
চুমু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি একসময় বিখ্যাত ছিল চায়ের আড্ডা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং বক্তৃতা-মিছিলের জন্য। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর জায়গাটা হয়ে উঠল ছাত্রলীগের হাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পিটুনিমঞ্চ। কিন্তু আষাঢ়ের বৃষ্টির একটা ইমেজ টিএসসির আমেজটাই বদলে দিল। গত সোমবার থেকে ফেসবুকে ভাইরাল হতে থাকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির মধ্যে বসে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আলতো করে চুমু খাচ্ছে। ছবিটা হাজির হওয়ামাত্র জাতি (মূলত ফেসবুক নিবাসি তরুণ-তরুণীরা) ধরণীকে দ্বিধা করে তার দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একদল এর মধ্যে প্রগতি, মানবতা, শান্তি, মুক্তি, নান্দনিকতা সব দেখতে চাইল। আরেকদল ঘরের কাজ বাইরে করা নিয়ে রেগে আগুন। অবশ্য মুত্রাঘাতে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা নিয়ে আমাদের কোনো শরম আছে বলে মনে হয় না।
চুমুর ছবিটা দেখে মনে পড়লো, বসনিয়ার গণহত্যা থেকে পালানো প্রেমিক-প্রেমিকার ছবি। মেয়েটা বসনিয়, ছেলেটা সার্ব। সার্বরা তখন বসনিয়দের মারছে। তার মধ্যে তারা নিজ নিজ জাতের হাত ছেড়ে প্রেমের হাত ধরে কোনো শান্তির পৃথিবীতে পালাতে চাইছিল। কিন্তু পারলো না। সমুদ্র সৈকতে তাদের জড়াজড়ি করা গুলিবিদ্ধ দেহ পৃথিবীকে থমকে দিল। বাংলাদেশের রক্তাক্ত বাস্তবতায় দুটি ছেলেমেয়ের প্রেমের দৃশ্য কিন্তু জানিয়ে গেল, জীবন থেমে নেই। এখনো দৃশ্যের জন্ম হয়, সুন্দরের জন্ম হয়।
কিন্তু সহসাই মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত ছবিটাকে সরিয়ে দিল এই প্রেমের ছবি। জাতি দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রশংসা ও নিন্দার বান বইয়ে দিল। সবারই মত দেবার অধিকার আছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যখন এই টিএসসিতে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আসা এক ছাত্রীকে ঘিরে ধরে হায়েনার মতো যৌন নিপীড়ন করছিল, যখন গণপরিবহনে প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন চলে, যখন রাজপথে নৃশংসতার জন্ম দেয়া হয়, তখন কি আমরা একইভাবে সাড়া দেই? আমাদের অনুভূতির অ্যান্টেনা কি সবার মানবতা স্বীকার করে? নাকি আমরা চাই, প্রেমের আলিঙ্গনের বদলে সমাজের নিন্দা সইতে না পেরে এক দড়িতে ফাঁস নেওয়ার ছবির জন্ম হোক?
রক্ত
বাঙালির যেমন আছে অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা, তেমনি আমাদের আছে সরল সত্য এড়িয়ে জটিলতা আবিষ্কারের মারাত্মক গুণ। মানহানির মামলায় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আদালতে হাজিরা দিতে কুষ্টিয়ায় গেলেন। আদালত জামিন দিলেও ছাত্রলীগের নেতারা খালাস দিলেন না। তাঁকে তাঁরা পিটিয়ে রক্তাক্ত করলেন, গাড়ি ভাংচুর করলেন, দলীয় স্লোগানে আদালতভবন কাঁপিয়ে দিলেন। একটা রক্তাক্ত দৃশ্যের জন্ম হলো। কিন্তু দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক মাত্রা ছাপিয়ে ছবিটা কারো কারো কাছে হয়ে উঠলো একটা প্রিজম। সেই প্রিজমে দৃষ্টি ফেলে যার যার দল, চিন্তুা, মানসিকতার আলোকে তাঁরা ঘটনার ভেতরের চিত্রনাট্য রচনা করে ফেললেন। কেউ আইনের অপলাপ দেখলেন, আদালত প্রাঙ্গনে রক্তাক্ত সন্ত্রাসের মধ্যে আইনের শাসনের খড় বা কুটার ভেসে যাওয়া দেখলেন। আবার কেউ দেখলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চরম অপব্যবহারকারীর শাস্তি, ব্লগার হত্যার উশকানিদাতার ‘থোতামুখ ভোঁতা করার’ উল্লাস, চেতনার বিজয় ইত্যাদি। জাতি এ ব্যাপারেও বিভক্ত হয়ে গেল। আইনের শাসনের জরুরত, আইন হাতে তুলে না নেওয়ার সভ্যতা, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন—এইসব নৈতিক বুলি কর্পুরের মতো উবে গেল। ঘৃণা মাদকের মতো, করতে থাকলে মস্তিষ্কে যে কষ জমে, ঘৃণিত ব্যক্তির মার-খাওয়া দেখলে সেই কষগুলি আনন্দরসে (ডোপামিন) পরিণত হয়।
এভাবে প্রতিহিংসা চালালে, চোখের বদলে চোখ নেয়া চলতে থাকলে একদিন যে দেশশুদ্ধ মানুষের যার যার শত্রু নিকাশে নেমে পড়ার আশংকা আছে, তার কী হবে? কী হবে চোখের বদলায় চোখ নিতে নিতে নিতে সবাই অন্ধ হয়ে গেলে? কথাগুলি মনে হয় যাত্রার বিবেকের মতো শোনাল!
সোহাগ
কথায় আছে, শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী এবং সরকারপক্ষের স্বনামধন্য বক্তা জনাব ওবায়দুল কাদের হঠাৎ মঙ্গলবার বাংলাদেশের বৃহত্তম বাম দল সিপিবির অফিসে হাজির হলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিতর্কিত চুমুর ছবি পাওয়া গেলেও, মাহমুদুর রহমানের মার খাওয়ার ছবি মিললেও এই অর্থপূর্ণ ঘটনার কোনো ছবি সিপিবি বা আওয়ামী লীগের তরফে প্রকাশিত হলো না। কিন্তু অন্য কিছু ছবি আমাদের সামনে আছে। সুন্দরবনের কিনারে রামপালে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে জাতীয় কমিটির ব্যানারে যে আন্দোলন চলছিল, সিপিবি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। সে আন্দোলনের ধাপে ধাপে অনেকবার সিপিবির নেতাকর্মীরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। সিপিবির অফিসে ঢুকেও পুলিশ পিটিয়েছে। আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগ এবং অপপ্রচার কিছুই বাদ রাখেনি সরকার। ওবায়দুল কাদের তখন সেই আন্দোলনকে উন্নয়নবিরোধীদের চক্রান্ত বলতেন।
আন্দোলনটা জনপ্রিয়তাও অর্জন করছিল। এমনই চাপ সরকারের ওপর তৈরি হয়েছিল যে, প্রকল্পের পক্ষে টেলিভিশন-রেডিও-সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, জনপ্রিয়তার ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই আন্দোলন উল্টাযাত্রা করল। বৌদ্ধ দর্শনে একটা কথা আছে, গঠিত হই শূন্যে মিলাই। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই হলো।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ২৭ আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে রামপাল প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যুক্তি ও ইচ্ছার কঠোরতা জানালেন। অমনি আমরা দেখলাম, আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এল। তারপর থেকে বড় কোনো কর্মসূচী আর দেখা গেল না। জাতীয় কমিটির বৃহত্তম অংশীদার হলো সিপিবি-বাসদ জোট। নিন্দুকেরা বলে, সরকারযন্ত্রের শাসনে আন্দোলনে যে বিরতি এল তা আর রতি মানে সক্রিয় হলো না।
সুতরাং শাসন মানলে সোহাগ মানতে অসুবিধা হবে কেন? ওবায়দুল কাদের যে সিপিবি অফিসে যাওয়া শাসনের মুদ্রার অপর দিক—একে বলে আদর-সোহাগের রাজনীতি। সোহাগ দেখাবার দরকারও পড়েছে বটে। সিপিবি-বাসদ অপর জোট বামমোর্চার সঙ্গে মিলে নির্বাচনী বামজোট গঠন করেছেন। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ছিল আন্দোলনের জোট। আর নবগঠিত বামজোট নির্বাচনমুখী জোট। এই জোট যাতে কোনোভাবেই বিএনপিকে নিয়ে গঠিতব্য বিরোধী জোটের পানে না তাকায়, শাসনের ডান হাত গুটিয়ে সোহাগের বাম হাত এগিয়ে দেওয়ার রহস্যটা কি সেখানেই?
যথারীতি এটা নিয়েও অনলাইন জগতে সমালোচনার ঢেউ জেগেছে। বামরা কি কোনো অস্বচ্ছ নির্বাচনকে বৈধতা দেবে? বিএনপি না এলেও কি তারা নির্বাচন করবে? এসব বিষয় পরিষ্কার হতে আরো সময় লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যোগাযোগের মধ্যে খারাপ কিছু নেই। সরকারের বিরোধিতা করতে করতেও আলাপ-আলোচনার দরজা খোলা রাখা যায়; যদি উদ্দেশ্যে কেউ অটল থাকে। কিন্তু নিন্দুকেরা তাতে থামছেন না। তাঁরা বন্দুকযুদ্ধের ঢলের মধ্যে সিপিবি নেতৃবৃন্দের প্রধানমন্ত্রীর ইফতার পার্টিতে যাওয়ার উদাহরণ তুলে এনে বলছেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
পরিশিষ্ঠ: এককোষী প্রাণী অ্যামিবা বিভক্ত হয় আপন প্রজাতি রক্ষার স্বার্থে। আর আমরা বিভক্ত হয়ে কেবলই জাতিকে কমজোরি করি। আর কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।