সাধারণত ধরে নেয়া হয় একটা রাষ্ট্র বা সমাজে যখন নীতি নৈতিকতার অভাব দেখা দেয় কিংবা এই ধরনের কোনো পরিস্থির সৃষ্টি হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেন, লেখালেখি করেন কিংবা যেকোনো ভাবেই হোক নিজদের অবস্থান তুলে ধরেন; যাতে করে দেশ বা সমাজের মানুষজন ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারে।
একটা উদাহরণ দেই।
পর্তুগালে আসার পর জানতে পারলাম আফ্রিকা থেকে আসা এক কালো ছেলেকে বাসের মাঝে এক হোয়াইট পর্তুগিজ নাকি বাজে ভাষায় গালি দিয়েছে বা নিগ্রো টাইপ এই ধরনের কোন শব্দ ব্যাবহার করেছে।
আমি যেহেতু এখানকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছি পড়াতে, তো এদের শিক্ষকদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কথা প্রসঙ্গে এখানকার ডিপার্টমেন্টের হেড বলছিল, আমিনুল, আমার ইচ্ছে ছিল কাল’ই তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হই, কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কাল আমাকে একটা প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যেতে হবে।
আমার যেহেতু এইসব প্রতিবাদ কর্মসূচি সম্পর্কে আগ্রহ বেশি, তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের প্রতিবাদ? এক আফ্রিকান ছেলের সঙ্গে আমাদের পর্তুগিজ এক ছেলে বাজে ব্যাবহার করেছে। এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। এভাবে চলতে থাকলে এই ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
চিন্তা করে দেখুন, ওদের দেশেরই কেউ একজন এক বিদেশিকে স্রেফ খারাপ ভাষায় কথা বলেছে, এর জন্য ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে!
আর আমাদের শিক্ষকরা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় একদল ছাত্র আরেকদল ছাত্র’কে মারছে, এই নিয়ে দেখলাম না কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করেছে। যেই একজন বা দুইজন একটু প্রতিবাদ করেছে, তাদের পারলে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে! এই যে তাদের সহকর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, এই নিয়েও দেখলাম না কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করেছে!
অবশ্য প্রতিবাদ করবে কি করে! এরা আসলে শিক্ষক হয় কিভাবে? বছর আটেক আগে আমার এক খুব কাছের মানুষ কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেছিল, আমি ওই সময়ের কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক’কে চিনতাম।
তো আমি আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে গেলাম তার ইন্টারভিউয়ের সময়। দেখি অন্যরা যারা আবেদন করেছে, তারা একদম ওপেন বলাবলি করছে, আমি এতো লাখ টাকা দিয়েছি, আপনি কতো দিয়েছেন?এইসব শুনে আমার চোখ তো কপালে উঠার জোগাড়!
এর আগ পর্যন্ত আমি জানতাম- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য এক ধরনের নেটওয়ার্কের দরকার হয়। অর্থাৎ আপনার যদি রাজনৈতিক লিঙ্ক থাকে কিংবা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে তাহলে হয়তো আপনার চান্স থাকে শিক্ষক হয়ে যাবার। কিন্তু তাই বলে- টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া! অবাক করা বিষয় হচ্ছে- যারা টাকা দিয়েছিল তারাই শিক্ষক হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এইতো কয়েকদিন আগে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে না পেরে। তাকে নাকি দশ লাখ টাকা রেডি রাখতে বলেছিল, সে রেখেও ছিল, কিন্তু শেষমেশ আর পেরে উঠেনি! কেন পেরে উঠেনি? কারন শুধু টাকা থাকলেই হবে না! সরকারি দল আর সেই দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলাদা একটা খাতিরও থাকতে হবে! নইলে আবার সমস্যা!
অর্থাৎ শিক্ষক হওয়ার জন্য আপনাকে আর আলাদা করে পড়াশুনায় ভালো হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। অন্য আর সব কিছুতে ভালো হলেই চলছে! আর এরাই পড়াচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রছাত্রী গুলোকে এভাবে মারা হলো; অথচ এই নিয়ে কোন শিক্ষক আজ পর্যন্ত সেই অর্থে কোন প্রতিবাদ করেনি। অথচ এরা আপনাদেরই ছাত্র। উল্টো যাদের মারা হয়েছে তাদের পরিচয় দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাসী হিসেবে। আজ’ই নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এই কথা বলেছেন।
তা মাননীয় ভিসি মশাই, তারা যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে তো দেশে আইন-আদালত আছে। আইন তাদের বিচার করবে। এভাবে মারার অধিকার কি দেশের আইন কাউকে দিয়েছে? আপনার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরেই এই ঘটনা ঘটেছে, আপনি এদের বিরুদ্ধে কী কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন?
অবশ্য ব্যবস্থা কিভাবে নিবেন। আপনি তো ভিসি হয়েছেনই এদের সাহায্য নিয়ে! এখন এদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গিয়ে না পদ’টাই হারিয়ে বসেন! তার চাইতে বসে বসে পদ উপভোগ করা যাক!
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর পড়াশুনা কিংবা জ্ঞান চর্চা হয় বলে আমার মনে হচ্ছে না। এখানে কেবল একটা চর্চা’ই ভালো করে হয়, সেটা হচ্ছে ঘৃণার চর্চা!
একটা দেশের ধ্বংস শুরু হয় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে, দুর্নীতি থেকে নয়। আর ওই শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস শুরু হয় খারাপ এবং অযোগ্য শিক্ষক থেকে। আর এভাবেই একটা জাতির ধ্বংস শুরু হয়ে!