স্বপ্নপূরণে পাচার চক্রের ফাঁদ

Slider টপ নিউজ

090659_bangladesh_pratidin_mediterranean_sea

কিছু দিনের বিরতি দিয়ে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইউরোপ ও আমেরিকায় মানব পাচারকারী চক্র। যে কোনো মূল্যে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ও ইউরোপ যাওয়ার প্রত্যাশীরা হচ্ছেন এই চক্রের সহজ শিকার।

নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পাতা চক্র পাচারের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই নতুন রুট ব্যবহার করছে। পেরু-আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল থেকে গুয়েতেমালা-বেলিজসহ ক্যারিবীয় বিভিন্ন দ্বীপ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের বিপজ্জনক পথ ব্যবহার করছে এই চক্র। আবার মেক্সিকো দিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রমের মতো রোমহর্ষক পদ্ধতিতেও পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশিদের। অন্যদিকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সেই বীভৎস খেলায় আবার মেতেছে এ দেশেরই কয়েকটি চক্র। এর মধ্যে একটি চক্রকে গ্রেফতারের পর আরও কমপক্ষে তিন সক্রিয় আন্তর্জাতিক চক্রের খবর পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গিয়ে বেশ কিছু যুবক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এমন খবরের ভিত্তিতে মাঠে নামে ভারতীয় গোয়েন্দরা। পরে মার্চের শেষার্ধে ভারতীয় গোয়েন্দারা কলকাতা ও বর্ধমান থেকে দুই বাংলাদেশিসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বাংলাদেশিদের ভারতীয় সাজিয়ে সেনজেন ভিসায় ইউরোপে পাঠাত। গোয়েন্দা তথ্যানুসারে, এই বাংলাদেশিরা প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে যায় কলকাতায়।
সেখানে একটি চক্রের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কলকাতা ও বর্ধমানের কয়েকজনের সঙ্গে। তারাই ওই বাংলাদেশিদের পরিচয়পত্র ও তারই ভিত্তিতে জাল পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়। সেই পাসপোর্ট নিয়েই গত আট মাসে সেনজেন ভিসা নিয়ে সাইপ্রাস ও গ্রিস যায় শতাধিক বাংলাদেশি। এই বাংলাদেশিরা নিজেদের দেশ থেকে ভিসা পাচ্ছে না বলেই জাল কাগজপত্র নিয়ে কলকাতা হয়ে বিদেশে যাচ্ছে। পরে দুই বাংলাদেশি মানিক হাসান ওরফে রমজান শেখ ও মহিরুদ্দিন মোল্লা ওরফে আজিজকে জেরা করে কাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছিল, তা জানার চেষ্টা করা হয়। এর মাসখানেক পর গত এপ্রিলে ঢাকায় জাল ভিসা চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া জিয়াউল হক জুয়েল, মো. জাকারিয়া মাহমুদ, মো. মাহবুবুর রহমান এবং মো. মামুন হোসেনের কাছ থেকে পুলিশ সেনজেনভুক্ত দেশ সাইপ্রাসে যাওয়ার জাল আমন্ত্রণপত্র, ১৪টি জাল ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট, ভিসা তৈরির সরঞ্জাম ও বিপুল পরিমাণ বিএমইটি কার্ড উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, চক্রটি বিভিন্নভাবে সাইপ্রাস, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে বিভিন্ন চাকরি দিয়ে লোক পাঠানোর অফার দিয়ে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকার চুক্তি করে। পরে আসল সেনজেন ভিসার ওপর কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে জাল সেনজেন ভিসা তৈরি করে প্রিন্ট করে সরবরাহ করে। এই ভিসা নিয়ে প্রতারণার শিকার হয় বিদেশ গমনেচ্ছুরা। পরে অবৈধ পথে তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করে চক্রটি। তারা ঢাকা থেকে প্রথমে শ্রীলঙ্কায় নিত অনঅ্যারাইভাল ভিসায়। পরে ভিজিট ভিসায় তুরস্ক বা সাইপ্রাস নিয়ে সেখান থেকে ইউরোপের অন্য দেশে মানুষ পাচার করত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, বেশিরভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। সর্বশেষ যোগ হয়েছে আমেরিকা। মেক্সিকো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় মানব পাচার হচ্ছে। এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। মার্কিন ফেডারেল কোর্টের তথ্যানুসারে, মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় গত তিন মাসে দেশটির সীমান্তরক্ষীর হাতে ধরা পড়েছে ১৭১ বাংলাদেশি। দালাল চক্রের প্রতারণার শিকার এসব বাংলাদেশি এখন আমেরিকার জেলে স্থান পেয়েছেন। ভাগ্য পরিবর্তন করতে ঝুঁকিপূর্ণ সাগর ও সড়কপথে তাদের মেক্সিকো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ সময় তাদের মেক্সিকো রেখে পর্যায়ক্রমে আমেরিকার সীমান্ত পার করার সময় তারা ধরা পড়েন। এদের প্রতিজনের কাছ থেকে দালাল চক্র ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইইউর হিউম্যান ট্রাফিকিং পরিসংখ্যান বলছে, জাহাজে করে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালিতে পাড়ি দেওয়া লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকরা ঢাকা থেকে দুবাই অথবা জর্ডান বা মিসর অথবা তুরস্ক বা তিউনিসিয়া হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরপথে পাড়ি জমান ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে। জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলের খবর, কিছু লোকের কাছ থেকে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে গড়ে ৩-৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়। সরাসরি প্রতারিত এই ব্যক্তিরা কখনই দেশের বাইরে যেতে পারেন না। আরেকটি গ্রুপ, যাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ১০-১১ লাখ টাকা নেওয়া হয়, তাদের এই জাল কাগজপত্র দিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। এই চক্রগুলোর সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত। তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগও রয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশি এবং ওইসব দেশের কিছু নাগরিক পুরো চক্রের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ উত্তরের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *