বিশেষ সম্পাদকীয়: জানা-শোনা ভুল, বার বার বিয়ের আসর পন্ড করে

Slider টপ নিউজ রাজনীতি সম্পাদকীয় সারাদেশ

18920224_10210704474582759_3393820025592877316_n

১৮ জানুয়ারী তফসিল ঘোষণার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নাটকীয়ভাবে স্থগিত হয়েছিল। চার মাসের ব্যবধানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল গতকাল গাজীপুর সিটিতে। উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে রিট চ্যালেঞ্জে শিথিল মনোভাব প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। রিটের বিষয়বস্তু আগেই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জানা থাকলেও নিস্পত্তি করা ছাড়াই তপসিল ঘোষনা হয়। এ ছাড়াও তপসিল ঘোষনার পর কোন নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে আদালত সংবিধানের সুনির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ অনুসরণ করবে। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি, না করা হয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১২৫ ও ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনের বৈধতা
১২৫। এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও

(ক) এই সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন-বন্টন সম্পর্কিত যে কোন আইনের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না;

(খ) সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান-অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালীতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত ৮৫[ রাষ্ট্রপতি ৮৬[ * * *] পদে] নির্বাচন বা সংসদের কোন নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।

৮৭[ (গ) কোন আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরুপ কোন নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনরুপে কোন আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।]

নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সহায়তাদান
১২৬। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।

সুতরাং আদালত তপসিল ঘোষনার পর কোন রিট মামলায় নির্বাচন স্থগিতের চাহিদা থাকলে উপরে উল্লেখিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৫(গ) অনুচ্ছেদটি অনুসরণ করবেন। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন তপসিল ঘোষনার পর সংবিধানের ১২৫(গ) অনুচ্ছেদটি অনুসরণ করেছেন কি না জানিনা। তবে এই টুকু বলা যায়, রিট দাখিলের প্রথম শুনানীতেই আদালত নির্বাচন স্থগিত করেছেন। গাসিক নির্বাচনে যদিও বাদী বলেছেন তিনি বার বার রিট করেছেন কাজ হয়নি। গতকালের রিট তিনি নতুনভাবে আইনজীবী পরিবর্তন করে দাখিল করেছেন। এ ছাড়া রিটের বাদী নির্বাচন স্থগিত চান নি, বলে জানালেও রিটের বিবরণে স্থগিত চাওয়া হয়েছে। আর দুই সিটি নির্বাচনই আদালতের আদেশের খবর টিভিতে শুনার পর পরই নির্বাচন কমিশন সকল কাজ বন্ধ করে দেয়।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রেক্ষপট বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১৬ই জানুয়ারী স্থানীয় সরকার বিভাগ শিমুলিয়া ইউনিয়নের ডোমনা, দক্ষিণ বড়ইবাড়ী, পশ্চিম পানিশাইল, দক্ষিণ পানিশাইল, শিবরামপুর ও ডোমনাগ মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধেও রিট করেন গতকালের বাদী। রিটটি খারিজ হয়ে যায়। এরপর ২০১৬ সালে ওই ৬টি মৌজা নিয়ে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয় এবং রিটের বাদী চেয়ারম্যান হন।

সতুরাং ৬ মৌজার ভোটাররা দুই জায়গায় ভোট প্রয়োগ করেন। চলতি ২০১৮ সালের ৪মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় ওই ৬টি মৌজা ফের অন্তর্ভুক্ত করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের গেজেট দেয়। ৩১ মার্চ তপসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর গতকাল নতুনভাবে করা পুরাতন বাদীর রিট আবেদনের প্রথম শুনানীতে আদালত নির্বাচন স্থগিত করেন।

রিট আবেদনকারী এ বি এম আজহারুল ইসলাম পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। তিনি সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামীলীগের টিকিটে তিনি চেয়ারম্যান হন দুই বারই।

তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হোক, সেটা তাঁর চাওয়া ছিল না। মুখে এ কথা বললেও রিট আবেদনে তিনি ঠিকই নির্বাচন স্থগিতই চেয়েছেন। আর গতকালই তিনি এই রিটটি করেন। তবে এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘দরখাস্তে কোথায় কী যে আইনি লেখা হয়েছে! আমি বলতে পারব না।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সাভার ও গাজীপুরের প্রশাসন ওই রিট আবেদনকারীর তোলা প্রশ্ন সুরাহা করতে সব রকম প্রশাসনিক পদক্ষেপই নিয়েছিল। সাভার ও গাজীপুরের জেলা ও সদর থানা প্রশাসনকে দিয়ে গণশুনানি করেও এর নিষ্পত্তি করে দেয়। এমনকি তফসিল ঘোষণার এক মাস আগেও স্থানীয় সরকার বিভাগ আদালতে রিটের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে বলে সন্তুষ্টিও দেখিয়েছে।

এদিকে ১৮ জানুয়ারী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করে হাইকোর্ট। আলাদা দুটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বুধবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। এরপরই নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম।

আদেশের পর নির্বাচন ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ত্রুটি রেখেই ইসি এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এক মাস আগে থেকে তারা নতুন কাউন্সিলরদের মেয়াদ নির্ধারণ, হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের পর মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় দেয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে ত্রুটিগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। ভোটের বিষয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা। ইসির এক কমিশন সভায় আইনের ত্রুটির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কিছু আমলে নেননি। উল্টো বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নানা বিষয়ে ত্রুটির কারণেই নির্বাচন স্থগিত করেছেন আদালত। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন শেষ পর্যন্ত তাদের শঙ্কাই সত্য হয়েছে। তাদের মতে, ত্রুটিগুলো সংশোধন করে তফসিল দেয়া হলে রিট করার সুযোগ থাকত না। নির্বাচনও স্থগিত হতো না। নির্বাচন স্থগিতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতাকে দায়ী করছেন।

আদালতের আদেশের কারণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র উপনির্বাচন এবং নতুন যুক্ত ১৮ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কোটায় নারী সদস্য নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে। তিন মাসের স্থগিতাদেশের সঙ্গে ৯ জানুয়ারির তফসিল কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার সচিব ও নির্বাচন কমিশন সচিবকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ আদেশের পর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নির্বাচনের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হল। রিটের বাদীদের মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামীলীগের লোকও ছিল।

ঢাকা উত্তর সিটির পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন চলমান অবস্থায় স্থগিত হওয়ায় জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া চলছে। ফলে খুলনায় যদিও নির্বাচনী প্রচারণা জমজমাট, কিন্তু গাজীপুরের নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে পর্যবেক্ষকদের অনেকে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি নির্বাচনের ওপর একটা কালো ছায়া হিসেবে দেখতে পারেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচন স্থগিতের মত কারণ রেখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় কেন নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্লিয়ারেন্স দিল। আর নির্বাচন কমিশন জেনে-শোনে কেন বিরোধপূর্ন তপসিলে নির্বাচন ঘোষনা করলেন সেটা কারো বোধগম্য নয়। আর আদালতের আদেশ টিভিতে দেখেই নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষনিকভাবে কেন নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন তাও জানা নেই। আদালতের আদেশ হাতে পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কেনই বা এটর্নিজেনারেল দায়সারা কথা বলছেন তাও ভাবার বাইরে। নির্বাচন চলমান অবস্থায় আদালতই বা কেন সংবিধানের ১২৫(গ) অনুচ্ছেদকে যথেষ্টভাবে গুরুত্ব দিলেন না, তা বললে আদালত অবমাননা হবে।

তবে যাই হউক, ঢাকা উত্তর সিটির পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন চলমান অবস্থায় স্থগিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ মনে করছেন, বাকী সিটি নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন, এই নির্বাচন কমিশনের অধীন নিরাপদ নয়, তা অনেকটাই স্পষ্ট এখন। কারণ এই নির্বাচন কমিশন ভোট উৎসব করতে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এখন থেকে যে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে পুরোপুরি নিশ্চিত না হলে ভোটার বা প্রার্থীদের উচিত হবে না ভোট উৎসবে অংশ গ্রহন করার।

ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *