আমানতকারীদের সুরক্ষা করতে বাধ্যতামূলকভাবে আমানতের একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। আগে ১০০ টাকা আমানতের সাড়ে ৬ শতাংশ এবং গতকাল থেকে তা সাড়ে ৫ শতাংশ হারে সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংকের মোট আমানতের বিপরীতে ১২ এপ্রিল ১৮৬ কোটি টাকা সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি ওই দিন সংরক্ষণ করতে পেরেছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকটির এমন চিত্র উঠে এসেছে।
ব্যাংক বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষা করতেই বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাংকগুলোকে নগদে (যাকে ব্যাংকিং ভাষায় নগদ জমা বা সিআরআর) এ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু ব্যাংকটি সিআরআর সংরক্ষণ করতে না পারায় অর্থ আমানতকারীদের আমানত শতভাগই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাওয়া। ব্যাংকটির এ অবস্থা হওয়ার শুরুতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। তাহলে আজকের পরিণতি হতো না ব্যাংকটির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরীর গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকের যখন টাকার সঙ্কট দেখা দেয় তখন তারা প্রয়োজনীয় জামানত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করতে পারে না। বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। এ কারণে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাংকটির পুনর্জীবন দেয়ার কথা বলছে। সরকারি কয়েকটি ব্যাংক থেকে তহবিল যোগানের কথা বলছে। এটা করা হলেও এর পাশাপাশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে হয়ত ব্যাংক তার জীবন আবার ফিরে পাবে। আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন। অন্যথায় ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না হয় অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করতে হবে। বর্তমান অবস্থায় আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার সামর্থ্য নেই ব্যাংকটির। সবকিছু নির্ভর করছে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমানত নেয় তার পুরোটাই বিনিয়োগ করতে পারে না। নীতিমালা অনুযায়ী, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাড়ে ১৯ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকিং ভাষায় যাকে এসএলআর ও সিআরআর বলা হয়। বাকি সাড়ে ৮০ টাকা ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারে। এর মধ্যে দৈনিক ছয় টাকা এবং ১৫ দিন অন্তে সাড়ে ছয় টাকা সংরক্ষণ করতে হয় নগদে, (যা গতকাল থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে), যাকে ব্যাংকিং ভাষায় সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রিকয়ারমেন্ট) বলা হয়। আর বাকি ১৩ টাকা সংরক্ষণ করতে হয় সম্পদ দিয়ে। সম্পদ বলতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড (সরকারের ঋণের বিপরীতে ইস্যুকৃত বিল ও বন্ড) এবং সরকারি ব্যাংকের সরকারের ঋণের বিপরীতে সরকারের দেয়া গ্যারান্টি ইত্যাদি। সেসব ব্যাংক দৈনিক ছয় টাকা ও ১৫ দিন অন্তে সাড়ে পাঁচ টাকা নগদে সংরক্ষণ করতে পারে না, ওই ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর ৩৬(৪) এবং ৩৬(৫) ধারা মোতাবেক কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দেয়া নির্ধারিত হারে নগদ জমা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হলে দণ্ড সুদ, জরিমানা আদায়ের নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ক্রমাগতভাবে সিআরআর ঘাটতির ফলে গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংক তীব্র তারল্য সঙ্কটে রয়েছে। বর্তমানে এ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকের মূল তারল্য পরিমাপক সূচক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সিআরআর ঘাটতির বিপরীতে জরিমানাও মওকুফ করা যাবে না। এমনি পরিস্থিতিতে সিআরআর ঘাটতি কিভাবে আদায় করা যাবে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে ওই সূত্র জানিয়েছে, যেখানে আমানতকারীদের অর্থই ফেরত দিতে পারছে না সেখানে সিআরআর সংরক্ষণ কিভাবে করবে ব্যাংকটি। এর পরেও আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে একটি উপায় বের করতে হবে ফারমার্স ব্যাংকের জন্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হয়েছিল তা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের তারল্যসঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ দিকে এখন আর আমানত সংগ্রহে সাড়া পাচ্ছে না ফারমার্স ব্যাংক। উপরন্তু সাধারণ গ্রাহক আমানত তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।