কোটিপতি প্রতারক

Slider বিচিত্র সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

58375_f1

 

 

 

 

হ্যালো স্যার, আমি কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি। আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্টের এই নম্বরে কি নেটওয়ার্ক সমস্যা করে? ওপার থেকে ‘হ্যাঁ’ শোনার পরই তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়। বলা হয়, আপনাকে আমাদের কাস্টমার কেয়ার নম্বর থেকে ফোন দেয়া হবে। তারা যে নির্দেশনা দেবেন তা মেনে চললে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। পরে কাস্টমার কেয়ারের সংশ্লিষ্ট নম্বরের সঙ্গে মিল রেখে ফোন দেয়া হয়। কয়েকটি নম্বর ডায়াল করতে বলা হয়। এরপর মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায় ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে থাকা সব টাকা। বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারক চক্র কৌশলে সেই বিকাশ হাতিয়ে নেয়। এই প্রতারণা করে অনেকেই অল্প দিনেই কোটিপতি বনে গেছেন। এমনই একজন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার রায়নগর গ্রামের মো. ফারুক মাতবর। ২৮ বছর বয়স্ক এই যুবক এক সময় রাজধানীর গলিতে গলিতে ফেরি করে দিন পার করতো। রোববার গভীর রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর সদস্যরা ফারুককে তার গ্রামের আলিশান বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় তার আরো এক সহযোগী মো. রাজিব খান (২০)কে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। পিবিআইয়ে প্রাথমিক তদন্তে এলাকার বিকাশ প্রতারণার ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জুয়েল মিঞা জানান, রায়নগর এবং পার্শ্ববর্তী মিয়াপাড়া গ্রামের পৃথকভাবে কমপক্ষে ১৫-২০টি চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিকাশ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় তাদের প্রতারণার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এছাড়া, পাশাপাশি তিনটি জেলা ফরিদপুর, মাদারীপুর ও রাজবাড়ীজুড়ে প্রতারক চক্রের রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক।
পিবিআই সূত্র জানায়, রাজধানীর শ্যামপুর মার্কেটের বিকাশ এজেন্ট কাজী জাকির হোসেন ১৮ই মার্চ শ্যামপুর থানায় একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পরে ঢাকা মহানগর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এ স্থানান্তর করা হয়। মামলার বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, গত ১৮ই জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে দোকানে অবস্থানকালে জাকিরের বিকাশ নম্বরে অন্য একটি নম্বর থেকে কল আসে। গ্রামীণফোনের কাস্টমার সার্ভিসের লোক বলে পরিচয় দিয়ে তার বিকাশ নম্বরে নেটওয়ার্ক সমস্যা আছে কিনা জানতে চায়। কথা বলার একপর্যায়ে কাস্টমার কেয়ারের লোক পরিচয় দেয়া অজ্ঞাত ব্যক্তিটি কয়েকটি নম্বর ওঠাতে বলে তাতে কল করতে বলে। ওই নম্বরগুলোতে কল দেয়ার পর জাকির দেখতে পান তার মোবাইলের বিকাশ অ্যাকাউন্টে থাকা ৪৪ হাজার টাকা ০১৮৫০৮৫৪১৮৩, ০১৭৮২৮৬২২৬৭ নং এ চলে যায়। মামলাটি তদন্ত করেন ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. জুয়েল মিঞা। ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ দিকনির্দেশনা দেন। এই টিম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত মোবাইল ফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিসের লোক পরিচয় দেয়া  সংঘবদ্ধ চক্র সম্পর্কে পরে চাঞ্চল্যকর তথ্য পান। এসব তথ্য পাওয়ার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি টিম গত রোববার ২টা ৩৫ মিনিটে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার রায়নগর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ফারুকের আলিশান বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ওই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী মো. রাজিব খান (২০)কে। এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় প্রতারণা কাজে ব্যবহৃত ১৯৩টি বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সিম, ৫টি মোবাইল সেট ও ২টি টালি খাতা- যাতে বিভিন্ন নম্বর লেখা ছিল। আটক ফারুক ওই গ্রামের আবদুল খালেক মাতবর এবং মো. রাজিব খান ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের কবির উদ্দিন খানের ছেলে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সিম ব্যবহার করে বিকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইলে ফোন করে গ্রামীণফোনের কাস্টমার সার্ভিসের লোক পরিচয় দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এর আগে প্রায় ১০ বছর পূর্বে ফারুক মোবাইলের বিভিন্ন সিম ব্যবহার করে মোবাইল গ্রাহকদেরকে বিশেষ লোভনীয় পুরস্কার দেয়ার কথা বলে প্রতারণা ব্যবসা করে আসছিল। বর্তমানে সে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির বিকাশের কাস্টমার সার্ভিসের নম্বর ক্লোন করে নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন গ্রাহক ও বিকাশ এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। ফারুক দীর্ঘদিনে হাতিয়ে নেয়া টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। অল্প সময়ে তার এই উত্থান নিয়ে এলাকার লোকজনের মধ্যে কৌতূহলও রয়েছে। পিআইয়ের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারুক এক সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে কাঁচের গ্লাস বিক্রি করে বেড়াতো। গ্রেপ্তারকৃত রাজিব বিভিন্ন দোকান থেকে ভুয়া নামে রেজিস্ট্রি করা সিম সংগ্রহ করে এবং সেগুলো ফারুকের কাছে দেয়। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকা তারা ভাঙ্গা থানা এলাকার কতিপয় অসাধু বিকাশ দোকানদারদের কাছ থেকে ক্যাশ আউট করে। এছাড়া বিভিন্ন বিকাশের দোকান থেকে বিকাশ লেনদেনকারীদের মোবাইল নম্বরও সংগ্রহ করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো জানায়, অসাধু বিকাশ দোকানদাররা প্রতারক চক্রের নিকট ম্যাসেজের মাধ্যমে গ্রাহক বা টার্গেটদের মোবাইল নম্বর দিয়ে থাকে। এ চক্রের সঙ্গে আরো একাধিক সদস্যকে চিহ্নিত করা গেছে বলে জানিয়েছেন পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। অভিযান পরিচালনাকারী পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, এমন একটি এলাকায় বসে তারা এই প্রতারণার কাজটি করছিলো যেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। তারা আরো বলেন, এই বাড়িটি চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। যে কেউ চাইলেই সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। বাড়িটির ছাদের ওপর একটি ঘর রয়েছে, যেখান থেকে তারা প্রতারণার কাজ চালাতো। এছাড়া ঘরের বিভিন্ন জায়গায় নানারকম তার পেঁচানো এবং বড় গামলা টানানো রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারকরা জানিয়েছে, ভালো নেটওয়ার্ক সার্ভিস পাওয়ার জন্য এগুলো তারা ব্যবহার করতো। এসআই জুয়েল বলেন, তাদের এই প্রতারণার বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট। ফারুকের সহযোগী হিসেবে রাজিব ও তার ভাই সজীব বিভিন্ন দোকান থেকে ভুয়া আইডি কার্ড দিয়ে বিভিন্ন মানুষের নামে রেজিস্ট্রেশন করে আনতো। কাস্টমার কেয়ারের লোক সেজে তারাই কথা বলতো। তারা কৌশল হিসেবে সরাসরি গ্রাহকের কাছে জানতে চাইতো বিকাশ একাউন্টের এই  নম্বরটিতে নেটওয়ার্কের সমস্যা হয় কিনা। যাদের অ্যাকাউন্ট করা নাই তারা তাদের জালিয়াতি ধরে ফেলতো। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফোন রেখে দিতো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নিশ্চিত হয়ে ফোন করতো। পিবিআই এই কর্মকর্তা আরো বলেন, তারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন রায়নগর এবং পার্শ্ববর্তী মিয়াপাড়া গ্রামে কমপক্ষে ১৫-২০টি বিকাশ প্রতারক চক্র রয়েছে। এছাড়া মাদারীপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য প্রতারকচক্র সক্রিয় রয়েছে। এই কাজে জড়িতরা কম শিক্ষিত হলেও প্রযুক্তিতে তাদের ব্যাপক দক্ষতা রয়েছে বলে জানান এসআই জুয়েল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *