প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুর মাধ্যমে চাপে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য কিছু কৌশল হাতে নিয়ে কাজ করছে ক্ষমতাসীনেরা। এর মধ্যে রয়েছে, সাংবিধানিক জটিলতা দেখিয়ে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনের আগে বাগে আনার চেষ্টা করা। এ জন্য দশম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারীদের নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরছে দলটি। এটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার সুযোগ পাবে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট। দ্বিতীয়ত, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন বিলম্ব হওয়ায় বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা। এতে তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও শীর্ষনেতাদের ওপর বিরাগভাজন হবেন এবং আস্থাহীনতায় ভুগবেন। তৃতীয়ত, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত- এই বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা, যাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা ধোঁয়াশার মধ্যে থাকেন এবং তৃণমূল থেকে সিনিয়র নেতাদের ওপর চাপ আসে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, তাদের প্ল্যান অনুযায়ী সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না-নেয়া বিএনপির নিজস্ব ব্যাপার। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা বর্জন করার অধিকার তাদের রয়েছে। গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই বলে নির্বাচন তো কারো জন্য থেমে থাকেনি। এ জন্য বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ডাকাডাকি করবে না আওয়ামী লীগ। তা ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ও সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তাদের মতে, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে এবং অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তারা। এই ইস্যুকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে বাগে আনার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীনেরা। তাদের মতে, নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর ৯০ এইচ (১) (ই) ধারা অনুযায়ী বিএনপি এবার নির্বাচনে আসতে বাধ্য। কেননা এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দল যদি পরপর দু’বার নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ওই দলকে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এ অবস্থায় দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিকে নিবন্ধন বাঁচাতে হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের অংশ নেয়ার বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তা ছাড়া, গত বুধবার সচিবালয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত নির্বাচনের মতো এবারও নির্বাচনকালীন সরকার ছোট হবে। দশম জাতীয় সংসদে যেসব দল প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে।
জানা গেছে, বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে তীর্যক মন্তব্য, সভা-সমাবেশ করলে বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে নতুন নতুন মামলার খড়গ ও ধরপাকড় এবং খালেদা জিয়ার জামিন বিলম্ব হওয়ায় বিতর্কিত বক্তব্য ছুড়ে দিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তির দেয়াল তৈরির চেষ্টাসহ নানা নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে বিএনপিকে চাপে রাখতে ব্যাপক তৎপর রয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন করে চেষ্টাতদবির করাটাও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপে রাখার অন্যতম কৌশল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বিএনপির বিকল্প হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন নতুন জোটকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারি দলের তৎপরতা থাকলেও কোনোভাবেই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা।
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহল থেকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল উপাধি পেয়েছে জাতীয় পার্টি। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে সরকারি দলকে। এটা বুঝতে পেরে আগে থেকেই তারা জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করেছে এবং বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য নির্বাচনী মাঠে আগেভাগেই সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের এসব বক্তব্য এবং নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই নির্বাচনের তোড়জোড়কে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি। সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একই কায়দায় ছলচাতুরি করে, প্রতারণা করে সরকার ফাঁকা মাঠে গোল করতে চায়। এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় অপরাজনীতি করে এবং অপসংস্কৃতির চর্চা করে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে তারা। সেই অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে যে কত ধরনের মিথ্যাচার করতে হবে তার ঠিক নেই। সুস্থ রাজনীতি মাথায় না থাকলে তো তারা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করবেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যে স্বৈরাচার উপাধি পেয়েছে। এখন দুই স্বৈরাচার একসাথে মিলেছে।
অন্য দিকে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা আসলে বিএনপিকে চাপে রাখার বিষয় নয়। বিএনপি আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা বক্তব্য দিয়ে থাকি। যেমন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। এতেই প্রমাণিত হয়েছে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজদের দলে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি জনগণের জানা উচিত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। সেটা তারা ভুল করেছে। আমরা আশা করি আগামী নির্বাচনে বিএনপি সেই ভুলটি করবে না। আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: আব্দুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, বিএনপি অগণতান্ত্রিক পন্থায় হাঁটছে, গণতন্ত্রবিরোধী কথা বলছে ও কাজ করছে, আমরা সেই বিষয়টা তুলে ধরছি। এটা বিএনপির পক্ষে যাক আর বিরুদ্ধে যাক তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সময় যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন তা বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল। আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপিকে প্রধান বিরোধী দল মনে করে। রাজনীতির মাঠকে গরম করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা মন্তব্য করলে জনগণের কাছে তা তেমন গুরুত্ব পায় না। তাই জনগণের কাছে নিজেদের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্যও বিএনপিকে নিয়ে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দেন তারা।